শুক্রবার (০৫ জানুয়ারি) সকালে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে লিখিত বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রতিটি নির্বাচনী জনসভা জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। এতে প্রমাণ হয়, নির্বাচন ঘিরে সারাদেশে নৌকার পক্ষে অদ্ভূতপূর্ব গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে দেশের ভোটাররা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার- ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, আপনারা জানেন, ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে নির্বাচনকে ঘিরে সারাদেশে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে নির্বাচন মানে হলো উৎসব, গণতন্ত্রের উৎসব। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বরং তীব্র শীত উপেক্ষা করে জনগণ নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়ে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ২৮টি রাজনৈতিক দল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে এবং ২৯৯টি আসনে মোট প্রার্থী আছেন ১ হাজার ৯শ ৭০ জন, যার মধ্যে ৪শ ৩৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। সুতরাং নির্বাচনটি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
‘গত ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বরাদ্দকৃত নির্বাচনী প্রতীক প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে প্রার্থীরা তাদের আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছিল। প্রত্যেক প্রার্থী যথাসম্ভব নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। সকল প্রার্থী নির্বিঘ্নে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় কর্মী-সমর্থকদের পাশাপাশি ভোটার এবং সর্বস্তরের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে,’ যোগ করেন তিনি।
কাদের বলেন, ইতোমধ্যে মার্কিন জরিপ সংস্থা আইআরআই বলেছে, শেখ হাসিনায় আস্থা বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ মানুষের। শেখ হাসিনা তার প্রজ্ঞা-মেধা, ধী-শক্তি ও সুদৃঢ় নেতৃত্বে দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। শেখ হাসিনা এখন আমাদের আস্থা ও ভরসার বাতিঘর। ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা টানা তিনবার জনগণের রায়ে নির্বাচিত হয়ে Anti-Incumbency মানসিকতাকে ভুল তত্ত্বে পরিণত করেছেন।
‘জনগণ পুনরায় তাদের রায় শেখ হাসিনাকে প্রদান করবে’ এমন বিশ্বাস আওয়ামী লীগের আছে জানিয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক বলেন, মহান আল্লাহ’র অশেষ রহমত ও সকলের অবিচল আস্থায় জনসমর্থনের সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করছে গণতন্ত্র, মুক্তি, কল্যাণ ও উন্নয়নের প্রতীক নৌকা। সোহরাওয়ার্দীর মার্কা, ভাসানীর মার্কা, বঙ্গবন্ধুর মার্কা নৌকা মার্কা এবারও জনগণের বিশ্বাস ও ভরসার প্রতীক হিসেবে তাদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিকামী বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি অর্জনে নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
কাদের বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র তথা বাংলাদেশের মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। অনেক সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সদা জাগ্রত গণমানুষের সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এদেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সংগ্রামে আওয়ামী লীগের অবদান অনস্বীকার্য।
তিনি বলেন, ২০০৮ থেকে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের চিত্র পাল্টে গেছে, দেশের প্রতিটি প্রান্তে উন্নয়নের ছোঁয়া পৌঁছে গেছে। ঘরে বসে মানুষ উন্নয়নের সুফল ভোগ করছে। ডিজিটাল সেবা এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কারিশম্যাটিক নেতৃত্বে স্বল্পোন্নত দেশে থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, করোনার অভিঘাত মোকাবিলা করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজকের বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ। আমরা ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছি।
বিশ্বব্যাপী চলমান অস্থিরতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৩তম অর্থনীতির দেশ উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৭শ ৯৩ মার্কিন ডলার। শেখ হাসিনার ওয়াদা অনুযায়ী আজ দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। পাশাপাশি, দারিদ্র্যের হার কমে হয়েছে মাত্র ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, অতি দারিদ্র কমে হয়েছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ এবং মানুষের গড় আয়ু বেড়ে ৭২ বছর ৮ মাস হয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। ২০১০ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই উপহার দিচ্ছেন। ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষকে তিনি জমিসহ ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছেন। দেশের ১০ কোটির বেশি মানুষ বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা পাচ্ছে। শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে মহাকাশ বিজ্ঞানের যুগে। সকল ষড়যন্ত্রকে মিথ্যা প্রমাণ করে শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ করেছেন। একই সাথে তিনি মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পূর্বাচলে শেখ হাসিনা এক্সপ্রেসওয়ে ও কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ করে দেশবাসীকে যোগাযোগে নবতর সুবিধা প্রাপ্তির সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, বিশ্ব নেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনার এই ম্যাজিক নেতৃত্বে ও কর্মযজ্ঞে বারংবার মুগ্ধ হয়েছে। তাই তিনি জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্যা আর্থ’-এ ভূষিত এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ১.৩ মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় ও সহযোগিতা প্রদান করে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ হিসেবে বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত হয়েছেন। শেখ হাসিনার কল্যাণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল, এক উদীয়মান সূর্য। তিনি বাংলাদেশকে আজ বিশ্ব পরিমণ্ডলে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছেন।
ওবায়দুল কাদের বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের সংবিধানের মূল বিধানের আলোকেই। নির্বাচন পরিচালিত হয় সাংবিধানিক ও স্বাধীন রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষের অধীনে। সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ রাষ্ট্র হিসেবে এই নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালন করছে। সংবিধানের বিধান (অনুচ্ছেদ ১১৮-১২৬) এবং আইন অনুযায়ী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নির্বাচন কমিশন। পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক দেশেই এই ব্যবস্থা চলমান।
নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও সত্যিকার অর্থে নির্বাচন সম্পর্কিত রেগুলেটর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকার যুগান্তকারী কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বলেও জানান তিনি।
কাদের বলেন, যে প্রতিষ্ঠান বিএনপি’র শাসনামলে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের আওতাধীন একটি প্রতিষ্ঠান ছিল, সেটি এখন Legislative, Executive এবং Judicial ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন রেগুলেটরী কর্তৃপক্ষে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত অশুভ জোট ক্ষমতায় আসার পর সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অত্যাচার- নির্যাতনের স্টিম রোলার চালায়। আওয়ামী লীগের ২১ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করে। ১৬ জন সাংবাদিককে হত্যা করে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২২ জন নেতাকর্মীকে হত্যা এবং ৫ শতাধিক নেতাকর্মী আহত করে। হাওয়া ভবন খুলে অবাধে চলতে থাকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুঃশাসন। যার ফলে বাংলাদেশ পর পর ৫ বার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনকালে (২০০১-২০০৬) যখন নির্বাচন ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করানো হয় তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল এবং মহাজোটের অন্যান্য শরিক দল নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে একটি অভিন্ন রূপরেখা ঘোষণা করেন। এই রূপরেখায় নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা এবং নির্বাচনী আইন ও বিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে মোট ৩০ দফা সুপারিশ করা হয়। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এরপর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে প্রবল জনমতের চাপে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে ১৪ দল উপস্থাপিত দাবী সমূহকে সক্রিয় বিবেচনায় নেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর দাবির উপর ভিত্তি করেই ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স: নির্বাচনে পেশী শক্তি ও অর্থের ব্যবহার বন্ধ: নির্বাচনে প্রার্থীর সম্পদের বিবরণী প্রকাশ, চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণের পর পরই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণের পথ বন্ধ করা, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে সম্ভাব্য জনপ্রতিনিধির তালিকা প্রণয়ন এবং সেখান থেকে মনোনয়ন প্রদান, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মধ্য থেকে নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসার নিয়োগসহ যে যে প্রক্রিয়ায় একটি নির্বাচন কলুষিত হতে পারে তার বিভিন্ন সংস্কার সাধন করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোটের করা ভোটার তালিকা হতে ১ কোটি ২৩ লক্ষ ভুয়া ভোটার বাদ দেওয়া হয়।
ক্ষমতাসীন দলের এই শীর্ষ নেতা বলেন, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই তৃতীয়াংশ ভোটে জয়ী হবার পর টানা তৃতীয়বারের মতো মেয়াদ পূর্ণ করতে যাচ্ছে। সরকার গঠনের পর ২০০৯ থেকে অদ্যাবধি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতিটির জন্য প্রয়োজনীয় আইন ও বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার ৮২টি সংস্কার করেছে। যার মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন’ পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে সর্বাধিক ক্ষমতা ও দক্ষতার সাথে তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি বলেন, এমনকি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্বাচন কমিশন গঠনে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যার অধীনে সাংবিধানিক পদের অধিকারীদের সমন্বয়ে সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইলেকশন কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
‘নির্বাচন কমিশন সর্বোচ্চ স্বাধীনভাবে কাজ করছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের বর্তমান ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের কোন ভূমিকা নেই। নির্বাচনের কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ডিসি-এসপিসহ অনেকে ইউএনও এবং ওসিসহ বিভিন্ন কর্মকর্তাদের বদলি করা হয়েছে। যা অতীতে কেউ করতে পারেনি। এবার আচরণবিধি ভঙ্গ করায় প্রায় ৬শ প্রার্থীকে শোকজ ও তলব নোটিশ দিয়েছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। পাশাপাশি আচরণবিধি ভঙ্গের জন্য প্রার্থীদের জরিমানাও করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সঙ্গে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োজিত করা হয়েছে সশস্ত্র বাহিনীকে।
‘নির্বাচন কমিশনের গৃহীত এসব পদক্ষেপ প্রমাণ করে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে নির্বাচনের অনুষ্ঠানের সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। পাশাপাশি নির্বাচন পর্যবেক্ষণে প্রায় ২শ জন বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে বাংলাদেশে আসছেন। ইইউ প্রতিনিধি দল আগে থেকেই দেশে আছে। আমেরিকার আইআরআই ও এনডিআই এর প্রতিনিধিরাও দেশে অবস্থান করছে। তাই সার্বিক বিবেচনায় আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হচ্ছে,’ যোগ করেন কাদের।
সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমরা সবসময় চেয়েছি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত সকল রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিক। নির্বাচন কমিশন বিএনপিকে আলোচনায় অংশ নিতে আহ্বান জানালে বিএনপি তা প্রত্যাখ্যান করেছে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকের জন্য আমন্ত্রণও বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা বললেও তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন পরিষ্কার যে গত কয়েক বছরে বিএনপির বিভিন্ন দফা-দাবি, সভা-সমাবেশ মূলত নির্বাচনকে প্রতিহত করার অংশ হিসেবে এসব কর্মসূচি দিয়েছিল। অতীতের যেমন জামায়াতের জন্য বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি, এবারও তারা জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন প্রতিহতের আন্দোলন করছে। অথচ জামায়াতের নিবন্ধন আদালতে রায়ে বাতিল রয়েছে। সেই অনিবন্ধিত যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি আগুন সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে।
কাদের বলেন, মূলত বিএনপি তথাকথিত আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস করছে নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য। তাই বিএনপির সহিংসতার চিরচেনা চরিত্র আবারও জাতির সামনে উপস্থাপিত হয়েছে। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে বিএনপি ও তাদের দোসররা আন্দোলনের নামে ধাপে ধাপে সহিংসতা প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সে প্রস্তুতির একটা নৃশংস রূপ জাতি দেখেছে গত বছরের ২৮ অক্টোবর। সেদিন তারা একজন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা ও ভাংচুর করেছে এবং জাজেস কমপ্লেক্সেও হামলা করেছিল।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়ে তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত ও তাদের মিত্ররা ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে আজ পর্যন্ত ২৩ দিন অবরোধ, ৬ দিন হরতাল কর্মসূচি দিয়ে সারাদেশে সহিংসতা ও নাশকতা চালিয়েছে। তাদের হামলা-সহিংসতায় একজন শ্রমিক লীগ নেতা ও দুইজন বাসের হেলপার নিহত এবং ট্রেনে নাশকতায় ৬ জন মানুষ নিহত হয়েছে। এ সময়ে ২০ জন বাস চালক ও হেলপার, পুলিশের ১৪৪ জন, আনসারের ২৫ জন, ফায়ার সার্ভিসের ৩ জন, ১০২ জন সাধারণ মানুষসহ অর্ধশতাধিক সাংবাদিককে অগ্নিদগ্ধ ও আহত করেছে অবরোধকারীরা। একই সাথে ২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগুন এবং মোট ৬৫৫টি যানবাহন ও ১০টি অ্যাম্বুলেন্স আগুন ও ভাংচুর করা হয়। পাশাপাশি, রেলে ২০টির বেশি নাশকতা করে ১২টি ট্রেনে ভাংচুর বা আগুন দেওয়া হয়।
‘বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের ৬টি দলীয় কার্যালয় ভাংচুর ও পোড়ানো হয় এবং খুলনায় আদালতের এজলাস কক্ষে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেওয়া হয়। ২০১৩/১৪ সালেও বিএনপি-জামায়াতের নির্মম পেট্রোল বোমা সন্ত্রাসে নারী-শিশুসহ ৩০৪ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। দশম সংসদ নির্বাচনের দিন বিএনপি-জামায়াত ২৬ জনকে হত্যা করেছিল, ৫৮২ টি স্কুলে আগুন দিয়েছিল। পরবর্তীতে অবরোধে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ৫শ জনের বেশি নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। সাড়ে ৩ হাজার মানুষকে তারা অগ্নিদগ্ধ করে এবং প্রায় ৪ হাজার যানবাহনে আগুন দিয়েছিল,’ যোগ করেন কাদের।
তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য ২৮ অক্টোবরের পর থেকে আজ অব্দি বিএনপি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং জাতীয় নির্বাচনকে বানচাল করার উদ্দেশ্যে টানা রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়েছে এমনকী আগামী ৬ জানুয়ারি থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত টানা ৪৮ ঘণ্টার হরতাল আহ্বান করেছে বিএনপি। এর অর্থ হলো জনগণকে ভোট প্রদান হতে বিরত রাখা, ইলেক্ট্ররাল প্রসেস বাধাগ্রস্ত করা। পৃথিবীর কোনো দেশে নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য এমন ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি দেওয়া হয়। তার কী কোনো নজির আছে? আমাদের বিদেশি বন্ধুরা বাংলাদেশে পশ্চিমাদের মানসম্মত গণতন্ত্র দেখতে চান। সেসব দেশে কী কোন রাজনৈতিক দল হরতাল দেয়? তাহলে তো যারা ইলেক্ট্ররাল প্রসেসকে বাধাগ্রস্ত করতে চায় তাদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ হওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, আপনারা দেখেছেন, বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতা অব্যাহত রেখেছে। আমাদের কাছে তথ্য আছে, এখনও তারা ভয়াবহ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। নির্বাচনের দিন সারাদেশে সন্ত্রাস ও সহিংসতা করতে পারে। নির্বাচনকে ঘিরে অনেক গুজব নানাভাবে বিএনপি-জামায়াত ছড়াচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভিন্ন ভুয়া ভিডিও ছড়াচ্ছে। আমরা তাই সতর্ক আছি ও সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানাই।
ভোটারদের উদ্দেশ্যে ওবায়দুল কাদের বলেন, আমরা দেশের ভোটারদের আহ্বান জানাই, আপনারা ব্যালটের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে, সহিংসতাকারীদের বিরুদ্ধে রায় দিবেন। যারা মা-শিশুকে ট্রেনে পুড়িয়ে মেরেছে, পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে মেরেছে, বাস হেলাপারকে যারা পুড়িয়ে মেরেছে সেই হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আপনারা জবাব দিবেন ব্যালটের মাধ্যমে। আপনাদের রায়ে আবারও পরাজিত হবে সকল অপশক্তি।
সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় ৭ই জানুয়ারি নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে শক্তিশালী করতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীরণের জন্য এই নির্বাচন গুরত্বপূর্ণ। এ নির্বাচনে মাধ্যমে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা আরও গতিময় হবে।
তিনি বলেন, ৭ই জানুয়ারি নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যেকটি ভোট নিশ্চিত করবে স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের প্রত্যয়কে বাস্তবে পরিণত করতে। আমাদের জনগণের একটি বড় অংশ তরুণ। এই তরুণ সমাজই হবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের মূল কারিগর। তারুণ্যের শক্তি বাংলাদেশের অগ্রগতি। প্রতিটি নতুন তরুণ ভোটারাদের সক্রিয় সর্মথন আগামী ৫ বছরে এক কোটি কর্মসংস্থানের সুবিধা প্রাপ্তিকে নিশ্চিত করবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-উন্নয়ন দৃশ্যমান-বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’ স্লোগানকে সামনে আমাদের নির্বাচনী ইশতেহার জনগণের সামনে উপস্থাপন করেছেন। আমরা এবারের ইশতেহারে ‘স্মার্ট নাগরিক’, ‘স্মার্ট সরকার’, ‘স্মার্ট অর্থনীতি’ ও ‘স্মার্ট সমাজ’ এ চারটি স্তম্ভের সমন্বয়ে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার ঘোষণা দিয়েছি। আমরা ভোটে নির্বাচিত হলে ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবো, ইনশাআল্লাহ। আমাদের নির্ভরতার প্রতীক শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে যে মর্যাদায় উন্নীত করেছেন, আমরা বিশ্বাস করি, দেশের জনগণ নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে তার প্রতিদান অবশ্যই দিবেন।
কাদের বলেন, টানা তিনবার সরকারে থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে ২০৪১ সালে উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংকল্প করেছেন।
পর্যবেক্ষক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে ইতোমধ্যেই বিদেশি সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক এসেছেন, তা দেখে আমরা উৎসাহিত বোধ করছি। তারা একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করবেন। আমরা আশা করবো, যে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তার সঠিক চিত্র তারা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরবেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মী-সমর্থকদের বলবো, নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে ভোট প্রদানে প্রত্যেক ভোটারকে সহযোগিতা করবেন। কোন অপশক্তি যেন নির্বাচনের দিন ও ফলাফল ঘোষণার পরও যেন হামলা, সংঘর্ষ ও সহিংসতা করতে না পারে সেজন্য সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। ভোটারদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, নিজে ও পরিবারের সবাইকে নিয়ে সকাল-সকাল ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন এবং অন্যকেও ভোটদানে উৎসাহিত করবেন।