বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকট, ঋণ আদায় কম, মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ, নগদ অর্থের অভাব—এসব সমস্যা নিয়ে বছরজুড়ে ধুঁকে ধুঁকে চলেছে ব্যাংক খাত। এরপরও ২০২৩ সালে বেশিরভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে।:
পরিচালন মুনাফা ব্যাংকের চূড়ান্ত মুনাফা নয়। পরিচালন মুনাফা থেকে ঋণের মান অনুযায়ী নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখতে হয়; পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হয়। এরপরই চূড়ান্ত হয় নিট বা প্রকৃত মুনাফা।
নানা সংকটের মধ্যেও ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা বেড়ে যাওয়া একরকম চমক মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে নানা উপায়ে ব্যাংকগুলো ভালো পরিচালন মুনাফা দেখালেও সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনামূলক চিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে প্রকৃত মুনাফা খুব ভালো অবস্থায় নেই।
দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। প্রান্তিক (তিন মাস) ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো তাদের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং সংশ্লিষ্ট স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে জমা দিতে হয়। এর আগে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ তাদের বার্ষিক সভায় আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করতে হয়। তারপর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য সেই প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট স্টক এক্সচেঞ্জ তাদের ওয়েবসাইটে প্রকআশ করেছে।
নিয়ম অনুযায়ী, স্টক এক্সচেঞ্জে জমার দেওয়ার আগে ব্যাংকগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে এসব তথ্য জানাতে পারবে না। তবে বিভিন্ন সূত্রে বেশ কিছু ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার তথ্য পাওয়া গেছে। যেসব ব্যাংকের তথ্য পাওয়া গেছে সেগুলোর বেশিরভাগেরই মুনাফা বেড়েছে।
রোববার (৩১ ডিসেম্বর) ছিল ব্যাংক হলিডে। এদিন ব্যাংকগুলো তাদের বিভিন্ন শাখা থেকে পাঠানো হিসাব একত্রিত করে বছরের আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে।
গত বছর ব্যাংক খাতের অনেক সমস্যা ছিল। বিশেষ করে ডলার সংকট ছিল। বিনিয়োগও তেমন বাড়েনি আবার বৈদেশিক বাণিজ্যও কম হয়েছে। তারপরও অনেক ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। এটা বাড়ার কারণ হলো নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ঋণ আদায় না করেও নিয়মিত দেখানো হয়েছে। এসব ঋণের সুদ আদায় হয়নি তারপরও আয় খাতে দেখিয়ে দিচ্ছে। তার মানে তার আয় বাড়ছে। এছাড়া আমানতের সুদও কম দিতে হয়েছে। পাশাপাশি সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ট্রেজারি বন্ডে ব্যবসা ভালো হয়েছে
ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণ পরিশোধে নীতি ছাড়ের কারণে অনেক ব্যাংকেরই আদায় কমেছে। কিছু ব্যাংক কৌশলে অনাদায়ী সুদও আয়ের খাতে নিয়ে আসায় পরিচালন মুনাফা বেশি দেখাচ্ছে।
আপাতদৃষ্টিতে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় উল্লম্ফন হলেও দীর্ঘমেয়াদে দেশের ব্যাংক খাতের ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী ঢাকা পোস্টকে জানান, গত বছর ব্যাংক খাতের অনেক সমস্যা ছিল। বিশেষ করে ডলার সংকট ছিল। বিনিয়োগও তেমন বাড়েনি আবার বৈদেশিক বাণিজ্যও কম হয়েছে। তারপরও অনেক ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। এটা বাড়ার কারণ হলো নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ঋণ আদায় না করেও নিয়মিত দেখানো হয়েছে। এসব ঋণের সুদ আদায় হয়নি তারপরও আয় খাতে দেখিয়ে দিচ্ছে। তার মানে তার আয় বাড়ছে। এছাড়া আমানতের সুদও কম দিতে হয়েছে। পাশাপাশি সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ট্রেজারি বন্ডে ব্যবসা ভালো হয়েছে।
যেসব ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে তার মধ্যে সবার উপরে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। ২০২৩ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) ব্যাংকটি পরিচালন মুনাফা করেছে দুই হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। তার আগের বছর ২০২২ সালে ব্যাংকটির মুনাফা ছিল দুই হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি (এসআইবিএল) পরিচালন মুনাফা করেছে ৬০০ কোটি টাকা। আগের বছর করেছিল ৫২০ কোটি টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংকের মুনাফা ৪৫৫ কোটি টাকা। আগের বছর ২০২২ সালে ছিল ৪১৫ কোটি টাকা।
চতুর্থ প্রজন্মের মধুমতি ব্যাংক ২০২৩ সালে পরিচালন মুনাফা করেছে ২২২ কোটি টাকা; আগের বছর করেছিল ১৮৮ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে এক হাজার ২৩ কোটি টাকা; আগের বছর ২০২২ সালে ছিল ৯২৮ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংক মুনাফা করেছে ৭০০ কোটি টাকা; ২০২২ সালে ছিল ১০৬ কোটি টাকা। কৃষি ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৭৪৯ কোটি টাকা; আগের বছর ছিল ৫৬১ কোটি টাকা। পূবালী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা এক হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা; আগের বছর ছিল ১১৩৩ কোটি টাকা।
যেসব ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে তার মধ্যে সবার উপরে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। ২০২৩ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) ব্যাংকটি পরিচালন মুনাফা করেছে দুই হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। তার আগের বছর ২০২২ সালে ব্যাংকটির মুনাফা ছিল দুই হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়নি। তাদের লোকসান হয়েছে প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) পরিচালন মুনাফা হয়েছে ২৫ কোটি টাকা। মেঘনা ব্যাংকের মুনাফা বেড়ে হয়েছে ১৬৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ব্যাংক খাতে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ নয় মাসে (জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর’২৩) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৪ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। লাগামহীন এই খেলাপি ঋণের মধ্যেও মুনাফা দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো।