সরকারের পদত্যাগের ‘একদফা’ দাবিতে গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে মহাসমাবেশের ডাক দেয় রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। সমাবেশ কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পুলিশ কনস্টেবল হত্যা, পিস্তল ছিনতাই, পুলিশের কাজে বাধা, ককটেল বিস্ফোরণ, নাশকতা, ভাঙচুর, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, গাড়ি পোড়ানো, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, হত্যাচেষ্টাসহ নানা অভিযোগে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তারের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ শীর্ষ নেতারা কারাগারে আটক রয়েছেন। আটক হয়েছেন বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।
নতুন করে তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু নেতাকে একটি করে মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। কিছু নেতাকে রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অন্য মামলাগুলোতে এখনো গ্রেপ্তার দেখানো না হলেও আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের আইনজীবীরা। গ্রেপ্তারের মামলায় জামিন চেয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে আবেদন করা হয়েছে। এ মামলায় জামিন পেলে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হতে পারে—এমন শঙ্কায় শীর্ষ নেতাদের জামিনে তাড়াহুড়া করছেন না আইনজীবীরা।
বিএনপির আইনজীবীরা অভিযোগ করছেন, তাদের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে একাধিক মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও সাজানো মামলা দেওয়া হয়েছে। একতরফাভাবে নির্বাচন করতেই সরকার পরিকল্পিতভাবে নেতাদের কারাগারে আটক রাখতে ফরমায়েশি মামলা দিয়েছে। একাধিক মামলা হলেও অপকৌশলের কারণে শীর্ষ নেতাদের অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে না। কারাগারে থাকায় আগাম জামিন নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আইনজীবীদের অভিযোগ, একটা মামলায় জামিন পেলে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের আরেক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে, যেন সহসাই তারা কারামুক্ত হতে না পারেন। গ্রেপ্তার দেখানোর মামলায় জামিন চেয়ে নিম্ন আদালতে আবেদন করা হয়েছে। সেখানে জামিন না পেলে হাইকোর্টে যাবেন বলে জানান তারা।
কয়েকজন তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কেন অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে না, সে বিষয়ে জানেন না। তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নির্দেশ দিলে তাদের এসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হবে।
গ্রেপ্তারের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস প্রেসিডেন্ট এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার মেজর (অব.) শাহজাহান ওমর, যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, যুগ্ম মহাসচিব শামসুজ্জামান দুদু, যুগ্ম মহাসচিব ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মজিবুর রহমান সারোয়ার, সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স, বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন ও উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক কারাগারে আটক রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৮ থেকে ১০টি করে মামলা রয়েছে। এর মধ্যে মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে পুলিশ কনস্টেবল হত্যাসহ আটটি মামলা হয়েছে। গত ২৯ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় রমনা মডেল থানায় করা মামলায় তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। আগামী ২০ নভেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে এ মামলায় তার জামিন শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। তবে অন্য সাতটি মামলায় এখনো গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলাসহ নয়টি মামলা হয়েছে। গত ১ নভেম্বর শাহজাহানপুর থানার অস্ত্র ছিনতাই ও বিস্ফোরক আইনের মামলায় তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে ৫ নভেম্বর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ মামলায় দায়রা জজ আদালতে জামিন আবেদন করা হয়েছে। তবে অপর মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। গত ৩ নভেম্বর পুলিশ কনস্টেবল হত্যা মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপনের ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ড শেষে গত ৯ নভেম্বর তাদের কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। একাধিক মামলায় তারা এজাহারনামীয় আসামি হলেও তাদের এখনো অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার মেজর (অব.) শাহজাহান ওমরের বিরুদ্ধে রমনা থানায় চারটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো না হলেও নিউমার্কেট থানার বাস পোড়ানো মামলায় সন্দিগ্ধ আসামি হিসেবে গত ৪ নভেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরদিন গত ৫ নভেম্বর আদালত তার চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে গত ৯ নভেম্বর তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। গত ৩ নভেম্বর অস্ত্র ছিনতাইয়ের মামলায় যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সারোয়ারকে ও গত ৫ নভেম্বর প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।
শামসুজ্জামান দুদুর বিরুদ্ধে নতুন করে আটটি মামলা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। তিন দিনের রিমান্ড শেষে গত ৯ নভেম্বর তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, এমরান সালেহ প্রিন্স, জহির উদ্দিন স্বপন ও আমিনুল হকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হলেও অন্য মামলায় এখনো গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি।
মির্জা ফখরুলের আইনজীবী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি, ২৮ অক্টোবরের পর থেকে মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে আটটি মামলা হয়েছে। অথচ মাত্র একটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। বিগত দিনে দেখা গেছে একটি মামলায় জামিন পেলে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বিএনপির শীর্ষ নেতারা যাতে তাড়াতাড়ি বের হতে না পারে তার অপকৌশল হিসেবে অন্য মামলায় এজাহারে নাম থাকা সত্ত্বেও গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে না।’
মির্জা আব্বাসের আইনজীবী মহি উদ্দিন চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে তথাকথিত মামলার এজাহারে নাম দেওয়া হয়েছে। তবে এসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে না এবং আমরা মামলা সম্পর্কে কোনো তথ্য পাচ্ছি না। আমরা ধারণা করছি, একটা মামলায় জামিন পেলে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হতে পারে।’
শাহজান ওমরের আইনজীবী মোহাম্মদ রমজান খান কালবেলাকে বলেন, ‘নিউমার্কেট থানায় বাস পোড়ানোর মামলায় সন্দিগ্ধ আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। রমনা মডেল থানায় চারটি মামলায় তাকে এজাহারনামীয় আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় পুলিশ গ্রেপ্তার না দেখানোয় জামিনের ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছি না। আমরা জানি, একটা মামলায় জামিন পেলে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে। দীর্ঘদিন কারাগারে আটক রাখার জন্য গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে না।’
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল কালবেলাকে বলেন, ‘বিএনপির নেতারা জামিন চেয়ে আবেদন করেছেন। শুনানিতে তাদের বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগ তুলে ধরা হবে এবং জামিনের বিরোধিতা করা হবে।’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন কালবেলাকে বলেন, ‘এক মামলায় জামিন পেলে আরেক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর কৌশল নিয়েছে পুলিশ। যে কারণে এখন বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে না। জামিন পেলেই গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে আটকে রাখতে চায় সরকার। আইন মন্ত্রণালয় নিম্ন আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করছে, যা কখনো করা উচিত নয়।’
নতুন মামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কেন গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে না, জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) ফারুক হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘যখন প্রয়োজন হবে, তখন গ্রেপ্তার দেখানো হবে।’