আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনীতিতে চলছে নানা সমীকরণ। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ পুরোদমে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করলেও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি চূড়ান্ত আন্দোলনে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কদর বেড়েছে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর। ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নিজস্ব বলয়ে ভেড়াতে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল। যে কোনো মূল্যেই তাদের সমর্থন চান তারা। দলীয় সরকারের অধীনে ‘আসন’র প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে নিতে চায় ক্ষমতাসীন দল। অন্যদিকে সরকার পতনের একদফার চলমান আন্দোলনে পাশে চাইছে বিএনপি। এজন্য নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষাসহ দিচ্ছে নানা প্রতিশ্রুতি। তবে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ রাজপথের আন্দোলনে থাকছে। কেউ কেউ নির্বাচনমুখীও। আবার পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন অনেকে। ইসলামি দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য। আরও জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দল ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ইসলামি দলের সঙ্গে কথা বলেছে। নির্বাচনে যেতে জোট গঠনের প্রক্রিয়াও চলছে। আবার কয়েকটি দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও সেরেছে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি। শুধু আলোচনায় সীমাবদ্ধ নয়, দলটি যোগাযোগের মাত্রা বাড়িয়েছে কয়েকগুণ। এর মধ্যে রোববার চরমোনাই পিরের দল ইসলামী আন্দোলন সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে। কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামার কথা রয়েছে দলটির। তফশিল ঘোষণার পরপরই বেশ কয়েকটি দল তাদের অবস্থান জানাবে। তবে ইসলামি বড় দলগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বিনা ভোটের সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। দাবি আদায়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। দেশে গণতন্ত্র ও মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান অবরোধ কর্মসূচি চলতেই থাকবে।’
ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলন এককভাবে নির্বাচন করতে চায়। তবে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। রোববার আবারও দলের অবস্থান স্পষ্ট করবেন দলীয় আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম।’
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ৪৪টি। এরমধ্যে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল), খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ও জাকের পার্টিসহ ১২টি ইসলামি দল রয়েছে। যার অন্তত ছয়টি দল কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক। ইসলামী আন্দোলন ছাড়া ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিসের শীর্ষ নেতারা অনেকেই হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সক্রিয়। যদিও হেফাজত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। তবে অনেকেই মনে করেন এ সংগঠনটির ভোটের মাঠে বড় ভূমিকা রয়েছে। খেলাফত আন্দোলন ছাড়া বাকি চারটি দল আগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে ছিল। নানামুখী চাপে দলগুলোর কোনোটিই এখন বিএনপির সঙ্গে নেই। বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন তারা। তবে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও ইসলামী ঐক্যজোট নামে দুটি খণ্ডিত অংশ বিএনপির সঙ্গে আছে, যাদের নিবন্ধন নেই। বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ও জাকের পার্টিও স্বতন্ত্রভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ তিন দলের নেতারা জানিয়েছেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের জন্য তারা সরকারের পাশে আছে। নিবন্ধনের বাইরে আরও প্রায় অর্ধশতাধিক ইসলামী দলকেও গুরুত্ব দিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
এদিকে ভোটের হিসাবে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকে ধর্মভিত্তিক বড় দল মনে করে রাজনৈতিক মহল। এর মধ্যে জামায়াত স্বতন্ত্রভাবে নিজস্ব শক্তি নিয়ে রাজপথে রয়েছে। দলটির নিবন্ধন বাতিল হলেও থেমে নেই তৎপরতা। বিএনপির সঙ্গে রয়েছে তাদের ‘সখ্যও’। যুগপৎ আন্দোলনে না থাকলেও অঘোষিতভাবে একই কর্মসূচি পালন করছে তারা। চরমোনাই পিরের দল ইসলামী আন্দোলনও সম্প্রতি বিভিন্ন কর্মসূচিতে নিজস্ব শক্তি প্রদর্শন করেছে। রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারবিরোধী কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনে থাকা বিএনপির সঙ্গেও দলটির ‘সম্পর্ক’ রয়েছে বলে অনেকে ধারণা করছেন। দলটির নীতিনির্ধারকরা জানান, দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবেন না। ইতোমধ্যে সরকারকে দেওয়া ৭ দিনের আলটিমেটাম শেষ হয়েছে শুক্রবার। তবে এই সময়েও দাবি আদায় না হওয়ায় রোববার সংবাদ সম্মেলন করে অবস্থান জানাবে দলটি।
বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, ‘আমরা সবাই নির্বাচনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। নির্বাচন কমিশন তফশিল ঘোষণা করলে প্রধানমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে বসবেন। তখন আমরা বসে সিট (আসন) ভাগাভাগি, বাড়ানো-কমানোর বিষয়ে আলোচনা করব। বিএনপি নির্বাচনে না এলে সেটার ওপর নির্ভর করে সেভাবে সিদ্ধান্ত হবে।’
ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী বলেন, ‘অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। তথা সরকারের প্রভাবমুক্ত। স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের আন্ডারে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন চাচ্ছি। এই মর্মে এখনো কারও সঙ্গে জোট করিনি, লিয়াজোঁও হয়নি। এর আগে আমরা মহাজোটে ছিলাম। এখন মহাজোটে নেই। জোট করিনি। নিজস্ব অবস্থান থেকে নির্বাচন করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছি। নির্বাচনি পরিবেশ না হলে নির্বাচনে যাব না।’
বাংলাদেশ মুসলিম লীগের মহাসচিব কাজী আবুল খায়ের বলেন, ‘দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না। সরকারকে বলে আসছি, সবকে নিয়ে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে। এ মুহূর্তে নির্বাচন করলে দেশের জন্য অনেক ক্ষতিকর। অর্ধেক মানুষ নির্বাচনে যাবে না। জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে না। ইসলামি সমমনা পাঁচটি দল আমরা একসঙ্গে আছি, আন্দোলন করছি। মাঠের পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছি।’
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র সহসভাপতি মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুক বলেন, ‘বড় দুই দলের যোগাযোগ নেই। আমরা এখনো নির্বাচনমুখী না। দেখি কোন কোন দল নির্বাচনে আসে। তারপর আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমেদ আব্দুল কাদের বলেন, ‘দল নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাব না। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তফশিল ঘোষণার আশা করছি না। তারপরও শিডিউল ঘোষণার পর অবস্থান জানাব।’
বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারমান মাওলানা এমএ মতিন বলেন, ‘এককভাবে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আগামী নির্বাচনের পরিবেশ নির্ভর করবে আমরা কিভাবে নির্বাচন করব।’