দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তাপ। সরকার পতনের একদফা দাবি আদায়ে হার্ডলাইনে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। এ দাবিতে আগামী সপ্তাহে দেশব্যাপী লাগাতার কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলটির হাইকমান্ড। নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা হলেই লাগাতার কর্মসূচি কঠোরভাবে পালিত হবে। এর আওতায় দেশব্যাপী সর্বাত্মক অবরোধ অথবা অবরোধ ও হরতাল একই সঙ্গে পালনের কথা রয়েছে। সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে ইতোমধ্যে সব সাংগঠনিক জেলায় বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে। নেতাকর্মীরা কোন কৌশলে কীভাবে মাঠে থাকবেন, এ বিষয়ে দেওয়া হয়েছে দিকনির্দেশনা।
মাঠের নেতাকর্মীদের পরিস্থিতি মূল্যায়নের পাশাপাশি গ্রেফতার এড়িয়ে কর্মসূচি সফলের জন্য বলা হয়েছে। এদিকে সমমনাদের বাইরে আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে লাগাতার আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে আলোচনা চলছে। বিএনপি হাইকমান্ড তাদের সঙ্গে সরাসরি কথাও বলেছেন। ১২ নভেম্বরের মধ্যে তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাবেন বলে প্রত্যাশা করছেন দায়িত্বশীল নেতারা। দুপক্ষের অনমনীয় অবস্থানই বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এখনো সময় আছে আলোচনা বা সমঝোতার মাধ্যমে সংকট সমাধানের। জনগণ ও দেশের গণতন্ত্র রক্ষা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের বিকল্প নেই। সহিংসতা রোধের বিকল্প শুধু সংলাপ। কাজেই সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে তারা আলোচনায় বসার আহ্বান জানান।
নয় দিন ধরে হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। মাঝে বিরতি ছিল তিন দিন। বুধবার ভোর ৬টা থেকে ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি শুরু হচ্ছে। একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, তাদের প্রধান দাবি সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন, নতুন ইসি গঠন। দাবি না মেনে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করলে আরও কঠোর কর্মসূচি দেবেন। সেক্ষেত্রে তফশিলের দিন বা এর পরদিন থেকে দেশব্যাপী লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হবে। একই কর্মসূচিতে যাবে বিএনপির সমমনা দল ও জোট এবং জামায়াতে ইসলামী। কয়েকটি বাম রাজনৈতিক দল ও একটি নিবন্ধিত বড় ইসলামি দলও একই কর্মসূচিতে যেতে পারে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, সরকার ভেবেছিল ভয়ভীতি-সন্ত্রাস সৃষ্টি করে বিরোধী দলকে স্তব্ধ করে দেবে। কিন্তু চলমান কর্মসূচিতে দেশের মানুষ থেমে নেই। উসকানির মাধ্যমে একটি অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টির দায় বিএনপির ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার সরকারি পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। আজ দেশের মানুষ ইচ্ছায়, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রাজপথে নেমে এসেছে।
শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি আগামী দিনেও চালিয়ে যাব। দেশের আপামরসাধারণ আজ জেগে উঠেছে। সরকার তাদের কিছুতেই দমিয়ে রাখতে পারবে না। গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার চলমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জয় হবেই। সরকারের প্রতি অনুরোধ হিংসাত্মক পথ থেকে সরে আসুন। শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় একটি সমঝোতায় গিয়ে সরকার থেকে সরে দাঁড়ান। একটা সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ নিজেরাই খুলে দিন। এটা শুধু সরকারের জন্যই মঙ্গলজনক হবে না, দেশের জন্যও মঙ্গলজনক হবে।
এদিকে সরকারের কঠোর মনোভাব এবং দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোভাব নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করছেন নীতিনির্ধারকরা। নেতারা মনে করেন, চলমান আন্দোলন দেশে-বিদেশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। হরতাল ও অবরোধ উভয় কর্মসূচিতে জনগণের সমর্থন আছে। সরকারের দমন-পীড়নের বিষয়ে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক। সরকার দেশে ও দেশের বাইরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নীতিনির্ধারকদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে বিএনপিকে কঠোর কর্মসূচি নিয়েই রাজপথে থাকতে হবে।
একাধিক সিনিয়র নেতা বলেন, তাদের সামনে লাগাতার আন্দোলন ছাড়া বিকল্প নেই। সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার করে যতই ষড়যন্ত্র করা হোক, কোনো লাভ নেই। তফশিল ঘিরেই সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তফশিল ঘোষণার পর থেকে আন্দোলনে নতুন মাত্রা পাবে। এছাড়াও তাদের বিশ্বাস, খুব শিগগিরই সরকারের ওপর গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে আরও কঠিন চাপ আসবে। সেটা হলে নেতাকর্মীরা আরও চাঙা হবে।
লাগাতার কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে সমমনা দল ও জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও কথা বলছেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। এমনকি দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও তাদের পরাপর্শ নিচ্ছেন। এর বাইরেও বাম ও ইসলামি বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলেছেন। সমমনা দল ও জোটের বাইরে একটি ইসলামি দল আন্দোলনে থাকার ইঙ্গিত দিয়েছে বলে বিএনপির দায়িত্বশীল এক নেতা যুগান্তরকে জানান। ওই নেতা আরও জানান, কয়েকটি দল ১২ নভেম্বরের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাবে। এছাড়া চারটি ইসলামি দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। কৌশলগত কারণে দুটি সংগঠনকে মাঠে চাইছেন না হাইকমান্ড। তাদের সমর্থন হলেও আন্দোলনকে আরও বেগবান করা যাবে।
ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, সরকার ভাবছে বিরোধী দলকে তফশিলের ঘোষণা দিয়ে কাবু করবে। আসলে এটা একটি দুরাশামাত্র। আমরা বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের তফশিল ঘোষণার উদাহরণ অনেক দেখেছি। তফশিল ঘোষণার পর নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তিত হয়েছে, সেই উদাহরণও অনেক দেখেছি। শুধু তাই নয়, তফশিল ঘোষণার পরে যে নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছে, সেই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে বাতিল হয়েছে-সে উদাহরণও আছে। কাজেই তফশিল ঘোষণার হুমকি দিয়ে সরকার দেশের বিরোধী দল দূরে থাক, দেশের মানুষকেও কাবু করতে পারবে না। মানুষ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে নেমেছে, গণতন্ত্র আমরা অর্জন করবই।
এদিকে কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, গ্রেফতার নিয়ে কর্মীদের কপালে চিন্তার ভাঁজও পড়েছে। এ অবস্থায় দলটির উচ্চপর্যায়ের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, সিনিয়র নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের উদ্দেশ্য আছে। হতে পারে চলমান আন্দোলন থামানো এবং সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপিকে রাজি করানো। এর মধ্যে দলের নেতাকর্মীদের মাঝে নানা গুজব ও গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বলছেন, বিএনপির একটি অংশ দল ছেড়ে অন্য দলে গিয়ে নির্বাচন করবে। এজন্য দলের একজন নেতা কাজও করছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
তবে দলটির একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, ওয়ান-ইলেভেনসহ ১৭ বছর ধরে নানাভাবে নির্যাতনের স্বীকার নেতাকর্মীরা। হাইকমান্ডের নির্দেশের বাইরে তাদের নেতাকর্মীরা কেউ কোথাও যাবেন না। যতই চাপ বা প্রলোভন দেখানো হোক না কেন, নির্বাচনের আগ মুহূর্তে দল ভাঙার ষড়যন্ত্রে কোনো নেতা যুক্ত হবেন না বলে তাদের বিশ্বাস।
সূত্র জানায়, কয়েকদিন ধরে কেন্দ্রীয়সহ জেলা নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালে কথা বলছেন বিএনপি হাইকমান্ড। সাংগঠনিক জেলার প্রস্তুতিসহ নানা ধরনের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। উত্তরাঞ্চলের চারটি জেলার শীর্ষ নেতারা জানান, মূলত জেলার সব স্তরের নেতাকর্মীদের প্রস্তুতি সম্পর্কে একটা ধারণা নিয়েছেন হাইকমান্ড। ঐক্যবদ্ধভাবে চলমান আন্দোলন সফলের ওপর জোর দিয়েছেন। বার্তা দেওয়া হয়েছে, মাঠে থাকা নেতাকর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে। এ আন্দোলন নেতাকর্মীদের বাঁচা-মরার লড়াই। যে কোনো মূল্যে দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। দাবি মেনে না নিয়ে তফশিল ঘোষণা করা হলেও লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হবে। কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে একজন গ্রেফতার হলে আরেকজন আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবেন।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শরিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিরোধী দলগুলো এবং জনগণকে আস্থায় না নিয়ে একতরফা নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা দেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক সংকট আরও ঘনীভূত করবে। দেশকে ভয়ংকর বিপর্যয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেবে। এ ধরনের একটা পরিস্থিতি তৈরির দায়দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপরও বর্তাবে। আর বাস্তবে দলনিরপেক্ষ সরকার ছাড়া দেশে অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের কোনো অবকাশ নেই। দেশে আরেকটি নীলনকশা পাতানো নির্বাচন জনগণ কোনোভাবেই মেনে নেবে না।
এদিকে সংকট সমাধানে সংলাপের বিকল্প দেখছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, বড় দুই রাজনৈতিক দল তাদের অবস্থানে অনঢ় থাকলে সহিংস পরিস্থিতি অনিবার্য। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সহিংসতা বাড়াচ্ছে।
আমি মনে করি, উভয় পক্ষই এজন্য দায়ী। এ সহিংসতা প্রতিরোধ করার জন্য যাদের সক্ষমতা আছে, তারা তা যথাযথভাবে রোধ করছে কিনা সন্দেহ আছে। কাজেই সার্বিকভাবে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে। ফলে যারা সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছেন, প্রতিরোধ করছেন না, সাময়িক সুবিধা অর্জনে হয়তো এসব করছেন তারা। কিন্তু চূড়ান্ত বিবেচনায় এটা গণতন্ত্র, গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত। এতে গণতান্ত্রিক বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে। দেশে জনগণের স্বার্থের সঙ্গে এ প্রক্রিয়ার (সহিংসতা) কোনো সম্পর্ক নেই। জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতির অত্যাবশ্যকীয় হচ্ছে এই সহিংসতা। কাজেই সহিংসতা পরিহার করতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক সমস্যাগুলো এখন প্রকট হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে কোনো সংলাপ কিংবা সমঝোতা দেখছি না। সামনের সময়ে আরও সংঘর্ষ ও সংঘাত হবে। হয়তো আরও অবরোধ হবে। এর ফলে ফ্যাক্টরি, কলকারখানা, শিল্প উৎপাদন, রপ্তানি বাণিজ্য সবকিছুর ওপর এর প্রভাব পড়বে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আরও প্রকট হবে। সামাজিক জীবনে ব্যাঘাত ঘটবে। যতকিছুই হোক না কেন, সমঝোতা-সংলাপ ছাড়া সমাধান সম্ভব না।
কাল ভোর ৬টা থেকে ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ : এদিকে সরকার পতনের একদফা দাবিতে দ্বিতীয় দফা অবরোধের পর আবারও দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। আজ বিরতি দিয়ে কাল ভোর ৬টা থেকে শুক্রবার ভোর ৬টা পর্যন্ত এ কর্মসূচি পালন করবে দলটি। সোমবার বিকালে ভার্চুয়ালে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নতুন এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। একই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপিসহ সমমানা রাজনৈতিক দল। যুগপৎ আন্দোলনে না থাকলেও একই কর্মসূচি দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।