আগামীকাল ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে দুটি বড় রাজনৈতিক দল ছাড়াও ছোট-বড় অন্যান্য দল সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে। ফলে সারাদিন রমনা, মতিঝিল, গুলিস্তান ও নয়াপল্টন এলাকা লোকে-লোকারণ্য হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে কয়েক লাখ লোকের সমাগম ঘটবে ঢাকায়। জানা গেছে, বড় দুটি রাজনৈতিক দলকে সমাবেশের অনুমতি দিলেও জামায়াতে ইসলামীকে সমাবেশের অনুমতি দেবে না পুলিশ। যদিও দলটি সমাবেশের ঘোষণায় অনড় রয়েছে।
এদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, তারা আগামীকাল সাড়ে তিন হাত লাঠির মাথায় জাতীয় পতাকা ও সরকারের উন্নয়নের বার্তা নিয়ে সমাবেশে উপস্থিত হবেন। এ অবস্থায় একই সাথে রাজনৈতিক তিন দলের সমাবেশকে ঘিরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে ২৮ অক্টোবরকে ঘিরে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা বাড়ছেই।
একদিনে একই সাথে বড় তিন রাজনৈতিক দল এবং আরও কয়েকটি দলের সমাবেশের ঘোষণায় একে অপরকে হামলা, উস্কানি দেওয়া ও চূড়ান্ত পর্যায়ে মারামারির আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতনরা। মাঠে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা থাকলেও ক্ষমতাশীল দল আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের মারামারি বাধলে তা কতটুকু সামাল দিতে পারবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আগের তুলনায় পুলিশের সংখ্যা ও যান্ত্রিক সক্ষমতা বাড়লেও সেই ২০০৬ সালের মতো ২৮ অক্টোবরের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে তার নিয়ন্ত্রণ করা বর্তমান পুলিশের পক্ষে সম্ভব হবে না।
এদিকে ডিএমপির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, পল্টন, রমনা ও মতিঝিল এলাকায় থাকা আবাসিক হোটেলগুলোতে কারা উঠছেন কোথায় থেকে এসেছেন এসব বিষয়ে নজরদারি করা হচ্ছে। পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে ডিএমপির পক্ষ থেকে বসানোর সিসি ক্যামেরাগুলোতে সার্বক্ষণিক নজরদারি চলছে। বিশেষ করে মতিঝিল গুলিস্তান ও নয়াপল্টন এলাকা আগামীকাল সিসি ক্যামেরায় নজরদারি চলবে। এসব স্থানে কোনো ধরনের ঝামেলা হলেই স্টাইকিং ফোর্স সরাসরি মুভ করবে। প্রস্তুত থাকবে বিভিন্ন ধরনের জল কামান ও অ্যাপাচির মতো অত্যাধুনিক যানও। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার মতো তেমন কোনো তথ্য নেই গোয়েন্দাদের কাছে। তবে তারা কেউই আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না।
রাজনৈতিক বড় দুই দলকে সমাবেশ স্থল বদলানোর জন্য পল্টন থানা পুলিশের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাাজ। ফলে পুলিশ কাউকে নড়াতে পারেনি। এই অবস্থায় পুলিশের কড়া নজরদারি থাকবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ মহিদ উদ্দিন বলেন, সেদিন যে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটবে না সেটা আমরা বলতে পারি না। কেউ চেষ্টা করতে পারে সেক্ষেত্রে আমরা যে প্রচলিত আইন যেটা সেটার যথাযথ ব্যবহার করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষমতাশীল দল আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে তাদের শক্তির জানান দিতে ঢাকার আশপাশ ছাড়াও বিভিন্ন জেলা থেকে কর্মী বাহিনী নিয়ে আসবে। কয়েক লাখ লোকের সমাবেশ করবে তারা।
অন্যদিকে বিরোধীদল বিএনপি তারাও সরকারের শেষ সময়ে সমাবেশের সুযোগে সরকার পতনের প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নামবে। বিরোধী দলের এমন সমাবেশ ঘিরে নৈরাজ্য করার চেষ্টা করা হলে আওয়ামী লীগ তা প্রতিহত করবে বলে কেন্দ্র নেতারা জানিয়েছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তারা লাখের উপরে কর্মী বাহিনী জড়ো করবেন।
আগামীকাল ২৮ অক্টোবরকে ঘিরে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার কারণ অনেক। আজ থেকেই প্রায় ১৭ বছর আগে সরকারের শেষ দিকে এই তারিখে পুরানা পল্টন মোড়ে সমাবেশ ডেকেছিল চার দলীয় জোট ও জামায়াতে ইসলামী। সেই সমাবেশকে কেন্দ্র করে সেই সময়ের বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতকর্মীদের সাথে চারদলীয় জোটের নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া তুমুল মারামারির ঘটনা ঘটে। সেদিন ঢাকার আশপাশসহ বিভিন্ন জেলা থেকে লগি-বৈঠা নিয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কর্মীরা জড়ো হয়েছিল। সেদিন ত্রিমুখী সংঘর্ষে জামায়াতে ইসলামীর ছয় নেতাকর্মী নিহত হয়। তবে সেই হত্যার এখনো বিচার হয়নি। সেদিন অভিযোগ উঠেছিল, জামায়াতের এই ছয় নেতাকর্মীকে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে। অবশ্য সেই হত্যার ভিডিও সেই সময় গণমাধ্যমে প্রচারের ফলে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। সেই ভিডিও ক্লিপ এখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে। ফলে ধর্মভিত্তিক দল জামায়াত তাদের ৬ কর্মীকে হত্যার
প্রতিশোধ নিতে মতিঝিলে সমাবেশ ডেকেছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। দলটির ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মতিঝিলের সমাবেশ সফল করার জন্য ইতোমধ্যে হাজার হাজার নেতাকর্মী রাজধানীতে প্রবেশ করেছে। তারাও সেদিন আওয়ামী লীগের মতো লাঠি সোটা নিয়ে প্রস্তুত থাকবে বলে জানা গেছে।
আবারও সেই ২৮ অক্টোবর। এবার প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন। তবে এটিও সরকারের শেষ সময়ে। তখন সরকারে ছিল জোট সরকার আর এখন টানা প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। সরকারের শেষ সময়ে একই দিনে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ ও ১২ দলীয় জোট পৃথক পৃথক জায়গায় সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বাইতুল মোকাররম দক্ষিণ গেটে সমাবেশ করবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। বিএনপি নয়াপল্টনে, জামায়াত মতিঝিলে, গণতন্ত্র মঞ্চ মৎস্যভবন মোড়ে, ১২ দলীয় জোট বিজয়নগরে সমাবেশ করবে। সব মিলে বলতে গেলে আগামীকাল দিনভর রমনা, মতিঝিল, নয়াপল্টন ও গুলিস্তান এলাকা রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ভিড়ে গমগম করবে।
তবে অন্য দলগুলো সমাবেশের অনুমতি পেলেও ধর্মভিত্তিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সমাবেশের অনুমতি পাচ্ছে না। যা পুলিশের পক্ষ থেকেও সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে জামায়াত ১৭ বছর আগের তাদের নেতাকর্মী হত্যার বদলা নিতে পুলিশের অনুমতি ছাড়াও সমাবেশ করতে নামতে পারে ও ক্ষমতাশীল দল আওয়ামী লীগের উপর হামলা করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে তাদের যতো প্রস্তুতি থাকুক না কেন পুলিশ তাদের মতিঝিল এলাকায় দাঁড়াতে দেবে না বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ডিসি হায়াতুল ইসলাম খান ঢাকা মেইলকে বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে যেহেতু বিনা অনুমতিতে সমাবেশের জন্য আসবে এজন্য আমরা কঠোর থাকব।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু তাদের অনুমতি দেওয়া হবে না এ কারণে মতিঝিল এলাকায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের ঢাকার বাহির থেকে আসতে নানাভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে। ঢাকার বিভাগ থেকে বৃহস্পতিবার রাতে যারা ঢাকায় এসেছেন অনেককে বাসে ওঠার আগে তারা কেন ঢাকা আসছেন, কি কাজে যাচ্ছেন, কোথায় এবং কার বাসায় উঠবেন পাশাপাশি কবে তারা ফিরে যাবেন, এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। যদিও বিষয়গুলো নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ কথা বলছে না।
ক্ষমতাশীল দল আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানিয়েছে, আগামীকাল ২৮ অক্টোবরকে ঘিরে তারা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মীদের হাতে সাড়ে তিন হাত লাঠি নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা ঢাকার প্রবেশ পথগুলোতে সেই এলাকার আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে লোকজনকে জড়ো করতে প্যান্ডেল বানানো হয়েছে। সকাল থেকেই তারা রওনা হবেন গুলিস্তানের দিকে। বিকেলের দিকে বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীরা কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করলে তার সমুচিত জবাব দেবেন তারা। সেই আভাস আগেই দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সম্প্রতি তিনি এক সভায় বলেছেন, রাস্তা ছাড়বেন না। আক্রমণ করব না, এ পর্যন্ত আমরা বিরোধী দলের উপর আক্রমণ করিনি। আক্রমণ করলে পাল্টা আক্রমণ করব। কোনো ছাড় নয়।
তবে এতগুলো রাজনৈতিক দল একসাথে সমাবেশ করার ফলে বিশৃঙ্খলা, মারামারি, হামলা, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা যে ঘটবে না তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও উড়িয়ে দিচ্ছে না। তবে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে রাজধানীর প্রবেশ মুখগুলোতে ছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় তল্লাশি চেকপোস্ট বসাবে পুলিশ ও র্যাব। ঢাকা শহর জুড়ে থাকবে কয়েক হাজার পুলিশ। প্রতিটি রাস্তায় টহল দেবে র্যাব। আরও দায়িত্ব পালন করবে সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, নাশকতা বা কোনো ধরনের মাঠ উত্তপ্ত করার মতো অবস্থা তৈরির তথ্য তাদের কাছে নেই।
এদিকে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার মঈন জানিয়েছেন, ২৮ অক্টোবরকে ঘিরে কেউ কোনো ধরনের নাশকতা বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করলে তাকে আইনের আওতায় আনবেন তারা। এজন্য ঢাকায় র্যাবের তল্লাশি চেকপোস্ট বসাবে র্যাব।