ইসরায়েলের নেতানিয়াহু বাহিনীর নৃশংস হামলায় একের পর একে মরছে ফিলিস্তিনিরা। কিন্তু সমঝোতার কোনো আভাস মিলছে না। গাজার পর পশ্চিম তীরেও ইসরায়েলের হামলা বন্ধ হচ্ছে না। গতকালও এক হামলায় সাতজনের প্রাণ গেছে। পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলকেই বরং সমর্থন করছে। তারা তাদের জয় আশা করছে। কিন্তু যুদ্ধবিরতির কোনো কথা কেউ বলছে না। বরং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলের সামনে যুদ্ধবিরতির দাবিতে ইহুদিদেরই একটা গ্রুপ বিক্ষোভ করেছে। সেখান থেকে অন্তত ৫শ’ ইহুদিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গাজায় মানবিক সংকট, দেখার কেউ নেই: গাজার হাসপাতালে মঙ্গলবারের হামলায় এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। এরপর বুধবার রাতেও গাজার আরেকটি হাসপাতালের কাছে হামলা হয়েছে। এ মাসের সাত তারিখ থেকে শুরু হওয়া সংকট ক্রমশঃ উত্তপ্ত হচ্ছে। সর্বশেষ গাজায় হাসপাতালে বিমান হামলার পর সংকট নিরসনের সম্ভাবনা আরো ক্ষীণ হয়ে গেছে। নেতানিয়াহুর সরকারসহ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স এই হামলাকে আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে বর্ণনা করছে।
গাজায় পরিস্থিতি এমন যে, লাশ দাফন করতেই দিন কেটে যাচ্ছে অনেকের। এক স্বজনের লাশ দাফনের পর আরেকজনেরটি দাফনের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। অনেক মৃতদেহ দীর্ঘক্ষণ হাসপাতালে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। অব্যাহত হামলা ও অবরোধের মুখে বন্ধের পথে গাজার একমাত্র ক্যান্সার হাসপাতাল। জ্বালানি সংকটে দেওয়া যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় চিকিত্সা। তুরস্ক-ফিলিস্তিন ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালটি রেডিওলজির মতো কিছু পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছে। গাজা উপত্যকার চিকিত্সকরা জরুরি চিকিত্সা সামগ্রীর তীব্র সংকটে রয়েছেন। তাদেরকে হাসপাতালের মেঝেতে রোগীদের অস্ত্রোপচার করতে হচ্ছে, বেশিরভাগ সময় কোনও চেতনানাশক ছাড়াই।
সমঝোতার আভাস নেই
পেছন থেকে কাতার, মিশর ও সম্ভবত আরো কয়েকটি দেশ জিম্মিদের একাংশের মুক্তির জন্য তত্পরতা চালাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। একটি ধারণার কথাও শোনা যাচ্ছে যে হামাস নারী ও শিশু বন্দীদের মুক্তি দেবে এবং বিনিময়ে ইসরাইল ৩৬ নারী ও কিশোর বন্দীকে ছেড়ে দেবে। ইসরাইলের রেইচম্যান ইউনিভার্সিটির ইন্সটিটিউট ফর পলিসি অ্যান্ড স্ট্রাটেজির সিনিয়র বিশ্লেষক মাইকেল মিলস্টাইন বলছেন যে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যে কোন মূল্যে জিম্মি হওয়া ব্যক্তিদের ফেরত পাওয়াই হতো ইসরাইলের বড় অগ্রাধিকার। কিন্তু এখন তাদের অগ্রাধিকার হলো সামরিক হুমকি হিসেবে হামাসকে নির্মূল করা। উভয় পক্ষেই উত্তেজনা ও ক্রোধ বাড়ছে। ইসরাইল ও হামাস-কারও মধ্যেই সমঝোতার মেজাজটাই নেই।
ইসরায়েলিরা হতভম্ব ও ক্ষুব্ধ যে বন্দুকধারীরা কীভাবে সহজেই দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্ত অতিক্রম করে ভেতরে ঢুকে ঠান্ডা মাথায় প্রায় বারো শ’ মানুষকে হত্যা করতে পারলো। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা, শুধু হামাস নয়, শনিবারের পর থেকে গাজায় দুই হাজারের মতো বিমান হামলার আড়াই হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যুতে ক্রোধে ফুঁসছে। গাজায় তেল, বিদ্যুৎ, পানি ও ঔষধ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কোন সতর্কতা ছাড়া বিমান হামলা চালিয়ে ইসরায়েল কোনো বেসামরিক নাগরিক হত্যা করলে জবাবে এর প্রতিটির জন্য একজন করে জিম্মিকে হত্যার ঘোষণা দিয়েছে হামাস। তবে এমন কিছু তারা করেছেন তেমন প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। একই সাথে ইসরায়েলের দিক থেকেও সংযমের কোন আভাস নেই। গাজার বড় অংশকেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। তবে মাইলস্টেইন বিশ্বাস করেন যে হামাস হয়তো নারী, শিশু ও বয়স্কদের আটকে রাখতে আগ্রহী নাও হতে পারে। কারণ ব্যাপক বিমান হামলার মধ্যে তাদের উচ্চ মাত্রার যত্ন নেয়া সহজ নাও হতে পারে। হামাস তাদের অবস্থানও গোপন রাখার চেষ্টা করছে যাতে করে সেখানে ইসরায়েল কোন তথ্য না পেতে পারে। এর পরিবর্তে, হামাস চাইবে তাদের হাতে জিম্মি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে পূর্ণ সুবিধা আদায় করতে। আলোচনা হলেও যাতে এদের মুক্তির বিনিময়ে বড় কিছু আদায় করা যায়।
সহজ কোন বিকল্প নেই
জিম্মি প্রসঙ্গে বড় ধরনের সংকটে ইসরায়েলের সরকার। এখন কী সামরিক উদ্ধার অভিযান হবে, যেখানে কিছুটা ঝুঁকিও থাকবে? নাকি এটা দীর্ঘায়িত হবে, যতক্ষণ না হামাস বিমান হামলায় দুর্বল হয় যা তাদের একটি সমঝোতায় আসতে আগ্রহী করে তুলবে। এসব বিকল্পগুলোর কিছু ঝুঁকি আছে। যদিও জিম্মিদের টানেল বা বাঙ্কারে রাখা হয়েছে বলে মনে করা হয়, তারপরেও বিমান হামলা থেকে তারা সুরক্ষিত নাও হতে পারে। এছাড়া জিম্মিকারীরা তাদের মেরে ফেলতে পারে- এ সম্ভাবনা সবসময়ই থেকে যায়। রাগের কারণেও এটি হতে পারে, আবার তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছে-এই ভয় থেকেও হতে পারে।
২০ বছর ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করা মাইকেল মিলস্টাইন সতর্ক করে বলছেন যে গাজার সব ঘরবাড়ি ও রাস্তার তথ্য আমাদের হাতে নেই’। সেখানেই হামাস নিজেদের ও তাদের জিম্মিদের ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় আড়াল করে রাখতে সক্ষম হবে। জিম্মি উদ্ধারে ইসরাইলের বিশেষ দক্ষতা অনেকবার প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৫৭ সালে তৈরি করা গোপন সায়েরেত মাতকাল ইউনিট অনেকটা আমেরিকার ডেল্টা ফোর্স কিংবা ব্রিটেনের এসএএস’র মতো।
নেতানিয়াহুকে যা বললেন সুনাক
ইসরায়েল সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেন, ‘হামাসের সঙ্গে এই লড়াইয়ে যুক্তরাজ্য ইসরায়েলের পাশে থাকবে। এই কঠিন সময়ে বন্ধু হিসেবে তোমার (নেতানিয়াহু) পাশে থাকতে পেরে গর্ববোধ করছি। আমরা তোমাদের সার্বভৌমত্বে পাশে থাকব। বন্ধু, আমরা তোমার জয় চাই।’ হামাসের কারণে ফিলিস্তিনিরাও মারা যাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলেই সৌদি আরবে যাওয়ার কথা রয়েছে ঋষি সুনাকের। এর আগে বুধবার ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে যুদ্ধের মধ্যেই ইসরাইল যান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বাইডেন বলেন, ‘ইসরায়েল তুমি একা নও, এ দুঃসময়ে আমেরিকাও তোমাদের পাশে আছে।’ তিনি বলেন, ‘আজ হোক, কাল হোক, ইসরায়েল ভবিষ্যতে একটি নিরাপদ ইহুদি ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে।
ক্যাপিটল হিলের সামনে বিক্ষোভ
গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলের সামনে বড় বিক্ষোভ করেছে ইহুদিরা। তবে বিক্ষোভে অভিযান চালিয়ে অন্তত ৫০০ ইহুদি বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করেছে মার্কিন পুলিশ। বুধবার ‘জিউইশ ভয়েস ফর পিস’ নামে একটি সংগঠনের সদস্যরা এই বিক্ষোভের আয়োজন করে। মার্কিন কংগ্রেসের ক্যানন রোটুন্ডার ভেতরে ঢুকে গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবিতে বিক্ষোভ করেন তারা। সেখান থেকেই তাদের গ্রেফতার করা হয়। বিক্ষোভকারীরা ‘এখনই যুদ্ধবিরতি’ এবং ‘মুক্ত কর, ফিলিস্তিন মুক্ত কর’ স্লোগান দেয়। সংগঠনটির এক্স (সাবেক টুইটার) পোস্টে বলা হয়েছে, ‘কয়েক শ আমেরিকান ইহুদি কংগ্রেসে অবস্থান করছে। কংগ্রেস গাজায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত আমরা এখানে অবস্থান করব। কয়েক হাজার মার্কিন ইহুদি বাইরে প্রতিবাদ করছেন। সাড়ে ৩০০ জন কংগ্রেসের ভেতরে আছেন।
দ্বিরাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধান চায় চীন, আব্বাসকে ফোন মোদির
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, এই সংকটের প্রধান সমাধান দুটি আলাদা রাষ্ট্র গঠন করা। তিনি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে জোর দেন এবং দ্রুত এই সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে ফিলিস্তিনের মাহমুদ আব্বাসকে ফোন করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। হাসপাতালে হামলায় হতাহতের ঘটনায় শোকপ্রকাশ করেছেন মোদি। তিনি ফিলিস্তিনকে সহায়তার দেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন।