চালু হতে যাওয়া ১৫০টি সেতু ও বিভিন্ন মহাসড়কের ১৪টি ওভারপাস বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় সুবিধা তৈরি করবে বলে মনে করছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সেতুগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জিডিপি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
অন্যদিকে সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর বলছে, সেতুগুলো ও ওভারপাস প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সমৃদ্ধ, নিরাপদ ও সময় সাশ্রয়ী করবে।
১৫০টি সেতু ও বিভিন্ন মহাসড়কের ১৪টি ওভারপাস উদ্বোধন প্রসঙ্গে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যোগাযোগের যে মেগা প্রকল্পগুলো আছে, সেগুলোর সুযোগ সুবিধা কিন্তু আমরা এরই মধ্যে পাওয়া শুরু করেছি। ১৫০টি সেতুর মধ্যে কিছু সেতু নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে এবং কিছু সেতু নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। এই সেতুগুলো আমাদের সীমান্তবর্তী এবং প্রান্তিক যে জনগোষ্ঠী আছে, তাদের যাতায়াতের বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এটাকে আমি অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখি। এতে করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হবে। আমাদের জিডিপি যদি বাড়াতে হয়, তবে আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে একটা ভালো যাতায়াতের সুবিধা দেওয়ার জরুরি। কারণ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে যদি একটি দ্রুতগতির যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে আনতে পারি তাহলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক সমৃদ্ধ হবে। এর ফলে জিডিপিতে বড় একটা কন্ট্রিবিউশনের সুযোগ হবে।
তিনি আরও বলেন, পাশাপাশি সড়ক-মহাসড়কের পাশে থাকা হাট বাজার ও রেলওয়ে ক্রসিংগুলোর জন্য সরাসরি চলাচল করা যানবাহনগুলোকে যানজটের মধ্যে পড়তে হয়। নতুন ১৪টি ওভারপাসগুলো তৈরি করার ফলে একটা নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হবে। এই ওভারপাসগুলো করিডোর ভিত্তিক যে উন্নয়ন এবং করিডোরের যে সুবিধা পাওয়ার কথা, সেই সুবিধা তৈরি হবে।
সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্রিজ ছিল না অথবা কোথাও ছোট ব্রিজ ছিল, সেখানে এবং সেগুলো বড় আকারে তৈরি হয়েছে। এগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও সমৃদ্ধ, নিরাপদ ও সময় সাশ্রয়ী করবে।
এ উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) তেজগাঁওয়ের সড়ক ভবনে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠান সূচি থেকে জানা গেছে, সকাল ১১টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশরীরে অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হবেন। এরপর তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল উদ্বোধন ও বৃক্ষরোপণ করবেন।
এরপর সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান স্বাগত বক্তব্য রাখবেন। তারপর সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কার্যাবলী সম্পর্কে একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা হবে। পরে উল্লেখযোগ্য অবকাঠামো ও আর্থিক সহায়তা বিষয়ে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপনা করবেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী।
এরপর বক্তব্য রাখবেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সংসদ সদস্য বেগম রওশন আরা মান্নান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
পরে দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের মধ্যে সহায়তা প্রদান করা হবে। ১২টা ২৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুভেচ্ছা স্মারক প্রদান করবেন এবং দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ ও উন্নয়নমূলক কাজের শুভ উদ্বোধন করবেন এবং মোনাজাতে অংশ নেবেন।
উন্নয়নমূলক কাজের মধ্যে রয়েছে— ১৫০টি সেতু ও বিভিন্ন মহাসড়কের ১৪টি ওভারপাস; ময়মনসিংহ জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের উপর কেওয়াটখালি সেতু ও রহমতপুর সেতুর নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন; ডিটিসিএ ভবন; বিআরটিএ’র স্বয়ংক্রিয় মোটরযান ফিটনেস পরীক্ষা কেন্দ্র, বিআরটিসি’র ময়মনসিংহ বাস ডিপো ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শুভ উদ্বোধন।
সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, আজ উদ্বোধন হতে যাচ্ছে ১৫০টি নতুন সেতু ও ১৪টি ওভারপাস। দেশের ৮টি বিভাগে মোট ৩৯টি জেলায় এ সকল সেতু ও ওভারপাসের অবস্থান। এর মধ্যে ময়মনসিংহ বিভাগে রয়েছে ৪০টি সেতু, ঢাকা বিভাগে ৩২টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ২৭টি ও রাজশাহী বিভাগে ২২টি সেতু। এছাড়াও খুলনা বিভাগে রয়েছে ১২টি সেতু, বরিশাল ও রংপুর বিভাগে রয়েছে ৮টি করে সেতু এবং সিলেট বিভাগে উদ্বোধন হচ্ছে একটি সেতু। এ ১৫০টি সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৯.৪৫ কিলোমিটার। উত্তরবঙ্গের যানজট নিরসনে ঢাকা-রংপুর জাতীয় মহাসড়কসহ (এন-৫) বেশ কয়েকটি মহাসড়কে নির্মিত ১৪টি ওভারপাসের মধ্যে ৮টি অবস্থিত রাজশাহী বিভাগে আর ৬টির অবস্থান রংপুর বিভাগে। এ ১৪টি ওভারপাসের মোট দৈর্ঘ্য ৬৮৯ মিটার।
এ সকল সেতু ও ওভারপাসগুলো দেশের সড়ক নেটওয়ার্ক উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ৫৫৮.২১ মিটার দীর্ঘ তিতাস সেতু, ৪০২.৬১ মিটার দৈর্ঘ্যের সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক সুরমা সেতু, বগুড়ার ২৯৮.৮০ মিটার দীর্ঘ আড়িয়ারঘাট সেতু, ১৯৩.৩০ মিটার দীর্ঘ ঢাকা জেলার নয়ারহাট সেতু উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে অদম্য অগ্রযাত্রার পরিচায়ক।
দেশজুড়ে বিভিন্ন মহাসড়কে অবস্থিত জরাজীর্ণ, অপ্রশস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বিদ্যমান বেইলি সেতুগুলো প্রতিস্থাপন করে নির্মিত আরসিসি সেতুগুলোর মধ্যে মোট ১৫টি সেতু উদ্বোধন হচ্ছে। যা জাতীয় মহাসড়কগুলোকে করবে আরও গতিশীল, নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ। এসব সেতুর মধ্যে গাজীপুরের ১৮৭.১৮ মিটার দীর্ঘ চাপাইর সেতু ও নারায়ণগঞ্জের ১৪৯.৮৭ মিটার দৈর্ঘ্যের রামচন্দ্রী সেতু উল্লেখযোগ্য।
দেশের সীমান্ত ঘেঁষে বিস্তৃত সড়ক নেটওয়ার্ককে আরও সচল করেছে ময়মনসিংহ বিভাগের সীমান্ত সড়কের সেতুগুলো। ময়মনসিংহ জেলার ৬৩.০৫ মিটার দীর্ঘ পশ্চিম নয়াপাড়া সেতু, নেত্রকোণার ৯২.৮০ মিটার দীর্ঘ মহিশখলা সেতুসহ সীমান্ত সড়কের মোট ১৯টি সেতু সীমান্তের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে পথচলাকে করবে আরও প্রাণবন্ত।
উদ্বোধনের অপেক্ষাধীন সেতুগুলোর মধ্যে রয়েছে জামালপুরে রৌমারী স্থলবন্দর-জামালপুর-ধানুয়া-কামালপুর-কদমতলা (রৌমারী) জেলা মহাসড়কে নির্মিত পাঁচটি সেতু। ৭৬.০১ মিটার ধানুয়া সেতু, ৫৬.৯৬ মিটার কদমতলা সেতু, ৫০.১২ মিটার ফুলকারচর সেতুগুলো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে বিভিন্ন পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতে ভূমিকা রাখবে এবং দুই দেশের সেতুবন্ধনকে আরও দৃঢ় করবে।
জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) সহযোগিতায় চলমান ‘ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রম্নভমেন্ট প্রজেক্ট (বাংলাদেশ)’ এর আওতায় নির্মিত ১৬টি সেতুর মধ্যে কক্সবাজার জেলার ৩২১.৪৫ মিটার মাতামুহুরি সেতু, চট্টগ্রামের ২৩৮.৩৫ মিটার সাঙ্গু সেতু, যশোরের ১২০.২০ মিটার ঝিকরগাছা সেতু, নড়াইল জেলার ১০৭.২০ মিটার তুলারামপুর সেতু, গোপালগঞ্জের ১০৫.২০ মিটার দৈর্ঘ্যের গ্যারাকোলা সেতু উল্লেখযোগ্য। ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রম্নভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় নির্মিত এসকল সেতু দেশের আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহযোগিতায় চলমান ‘সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প-২: এলেঙ্গা-হাটিকামরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণে’র মাধ্যমে নির্মিত ১৪টি সেতু উদ্বোধন হচ্ছে। ২৯৬.০০ মিটার দৈর্ঘ্যের সিরাজগঞ্জের নলকা সেতু, ১২২.২৩ মিটার দীর্ঘ জোড়া সেতু উন্মোচন করবে উত্তরাঞ্চলের জন্য সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। এছাড়াও এ প্রকল্পের অধীনে নির্মিত সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা ও রংপুর জেলায় অবস্থিত মোট ১৪টি ওভারপাস যানবাহনের নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করবে। ওভারপাসগুলোর মধ্যে ঢাকা-রংপুর-বাংলাবান্ধা জাতীয় মহাসড়কে নির্মিত বগুড়া জেলার ১৭৮.০০ মিটার দীর্ঘ চারমাথা ওভারপাস ও ১০৮.০০ মিটার দীর্ঘ মহাস্থান ওভারপাস রাজধানীর সাথে যোগাযোগকে আরও সহজ ও দ্রুততর করবে।
জাইকার অর্থায়নে চলমান ‘ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজ ইমপ্রম্নভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে নির্মিত ২১টি সেতুর মধ্যে নীলফামারী জেলার বাহাগিলি সেতু (১৯০.০০ মিটার), শরীয়তপুর জেলার গাজীপুর সেতু (১০৫.০০ মিটার), মাগুরা জেলার সীমাখালী সেতু (৮০.০০ মিটার) উল্লেখযোগ্য।