ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ ঋণ দিচ্ছে, সেই হারে আমানত পাচ্ছে না। এতে করে অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছে। ফলে দৈনন্দিন টাকার চাহিদা মেটাতে এক ব্যাংককে আরেক ব্যাংকের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিতে হচ্ছে।
এক ব্যাংক এখন অন্য ব্যাংক থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত সুদে টাকা ধার করছে। এক দিনের জন্য কলমানি মার্কেটে (অন্য ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করা) সুদহার ৭ দশমিক ৬২ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। বেড়েছে সরকারের টাকা ধারের অন্যতম মাধ্যম ট্রেজারি বিলের হারও। এই সংকট কাটাতে আমানতের সুদ বাড়াচ্ছে কিছু কিছু ব্যাংক। তবে খুব বেশি বাড়াতে পারছে না, কারণ, ঋণের সুদহার ১০ থেকে সাড়ে ১০ শতাংশে নির্দিষ্ট করে রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংকাররা জানান, করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ব অর্থনীতির নানা সংকট দেখিয়ে ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর সুযোগ নিয়ে ব্যাংকগুলোর অনেক বড় বড় গ্রাহক বছরের পর বছর ঋণ বাড়াচ্ছে কিন্তু টাকা ফেরত দিচ্ছে না। আবার অনেকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে লুটপাট করে বিদেশে অর্থ পাচার করে দিচ্ছে। এতে করে ব্যাংক থেকে যেভাবে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে সেই হারে ফেরত আসছে না।
আবার আমানতের সুদ হার এখন মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম বলে অনেকেই ব্যাংকেও টাকা রাখছেন না। ফলে নগদ প্রবাহে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এখন গ্রাহকের আমানতের অর্থ ফেরতসহ দৈনন্দিন টাকার চাহিদা মেটাতে গিয়ে এক ব্যাংককে অন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে হচ্ছে।
বেসরকারি সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্যাংকে টাকা কম। তাই নিজেদের তারল্য দিয়ে চলছে না। অন্য ব্যাংক থেকে বেশি সুদে ধার নিতে হচ্ছে। এ ছাড়া কিছু ব্যাংক রয়েছে যারা এমনিতেই দুর্বল, তারাও উচ্চ সুদে টাকা নিচ্ছে।
তিনি জানান, যদি সুদহারে সীমা না থাকতো তাহলে কলমানি রেট আরও বাড়তো। তবে মূল্যস্ফীতির এ সময় মুদ্রা বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। পাশাপাশি এক্সচেঞ্জ রেটে ছাড় দিতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, কলমানিতে বিভিন্ন মেয়াদে ধার দেওয়া হয়। ৯১ দিন, ৭ দিন, ৪ দিন, ২ দিন ও ১ দিনের মেয়াদে এই ধার দেওয়া-নেওয়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা ধার দেওয়া হয় এক দিনের মেয়াদে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, মঙ্গলবার (১৭ অক্টোবর) এক দিনের মেয়াদে কলমানিতে ৭ দশমিক ৬২ শতাংশ সুদে তিন হাজার ২৫১ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। আগের দিন সোমবার ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ সুদে লেনদেন হয়েছিল ৩ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। রোববার ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ সুদে ৩ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়। কলমানির পাশাপাশি ৫ থেকে ১৪ দিন মেয়াদে ব্যাংকগুলোর মধ্যে টাকা ধারের সুদও বেড়ে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ওঠে। এক বছর আগে ২০২২ সালের অক্টোবরে কলমানি রেট ছিল ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ২০১৬ সালের মে মাস থেকে কল মানি রেটের ডেটা পাওয়া গেছে। সেসব তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, গত ৭ বছরেরও বেশি সময়ে এতো বেশি রেটে ‘ওভারনাইট লোন’ দিতে দেখা যায়নি।
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কলমানির সুদ বাড়ার অর্থ ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে আছে। যখন তারল্য সংকটে থাকে তখন এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে স্বল্প সময়ের জন্য অর্থ ধার নিয়ে চলে। কলরেট বাড়া মানে বাজারে টাকার চাহিদা বেশি। তাই যাদের কাছে অর্থ আছে তারা সুদ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে ‘এসএমএআরটি’ বা ‘স্মার্ট’ রেটের কারণে বেশি নিতে পারছে না, কারণ নিয়ম অনুযায়ী ‘স্মার্ট’ রেটের সঙ্গে দুই শতাংশ কম বেশি কলমানির সুদ সীমা বেঁধে দেওয়া আছে। তা না হলে এই রেট আরও বেড়ে যেত।
তিনি আরও বলেন, একদিকে মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের টাকা জমানোর সক্ষমতা কমে গেছে। অন্যদিকে আমানতের সুদ হার কম। এর মধ্যে আসছে নির্বাচন। রাজনৈতিক সমস্যা হতে পারে এ ভেবে অনেকে টাকা নিজের কাছে রাখতে পারেন। এ ছাড়া ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর প্রতি সাধারণ আমানকারীদের আস্থা কিছুটা কমে গেছে। তাই আমানত কাঙ্ক্ষিতহারে আসছে না।
ব্যাংকারদের সাবেক এ নেতা বলেন, এ সময়ে তারল্য সংকট মানে টাকা ব্যাংকে না রেখে হাতে নগদ পড়ে আছে। আরও দুই-তিন মাস এমনই হবে।
সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, সোমবার (১৬ অক্টোবর) কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো রেপোসহ বিভিন্ন উপায়ে ধার করেছে ৫ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ওই দিন রেপো, স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি এবং লিকুইডিটি সাপোর্ট সুবিধার আওতায় ১৪ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা ধার নিয়েছে। যেখানে রেপোর সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
এদিকে নির্বাচনী বছরে অনেকে অর্থ হাতে রাখছে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোতে নজিরবিহীন ঋণ কেলেঙ্কারি, জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ পাচার ও তারল্যসংকটের জেরে অনেক গ্রাহকের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির চাপে খরচ বেড়েছে। সুদ কম হওয়ায় ব্যাংকে টাকা রাখার আগ্রহ হারাচ্ছে অনেকে। এ সব কারণে বছরজুড়ে ব্যাংকে টাকা না রেখে হাতে রাখার প্রবণতা বেড়ে গেছে।
দৈনন্দিন কেনাকাটা, বিভিন্ন ধরনের বিল পরিশোধ, বাড়ি ভাড়াসহ নানা কারণে অনেকেই সব সময় নগদ অর্থ কাছে রাখে। এ ছাড়া ব্যবসায়িক লেনদেন করতেও নগদ টাকার প্রয়োজন হয়। যখন মূল্যস্ফীতি বা জিনিসপত্রের দাম বাড়ে তখন নগদ টাকা রাখার প্রয়োজনীয়তা বেশি হয়। এর বাইরে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নগদে লেনদেন হয়। যা মানুষের হাতে থাকে। আবার হুন্ডিতে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বাড়লেও নগদ টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। তখন নগদ টাকার চাপ বাড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের আগস্ট মাসে ব্যাংক খাতের বাইরে টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪১ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি বছরের আগস্ট মাস শেষে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ, বছরের ব্যবধানে ব্যাংক থেকে মানুষের হাতে টাকা চলে গেছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা।
গত আগস্টে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। এ সময় ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত জুন ও জুলাই মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমার পর আগস্ট মাসে তা আবার বেড়েছে। আগস্টে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। এই সময় দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হঠাৎ অনেকটা বেড়ে গেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার উঠেছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে। যা বিগত বছরে কখনও হয়নি। এর আগের মাসে এই খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৭৬ শতাংশ। অর্থাৎ আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২.৭৮ শতাংশ।