এ বিষয়ে ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ডলার সংকটের সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। কারণ যে পদ্ধতিতে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে, তা সময়োপযোগী নয়। যখন অনেক বেশি রিজার্ভ থাকে এবং তা দিয়ে মাসের পর মাস জোগান নিশ্চিত করা যায়, তখন ডলারের দাম বেঁধে দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশের রিজার্ভ পরিস্থিতি সেই পর্যায়ে নেই। তিনি বলেন, ডলারের চলমান সংকট মোকাবিলা করতে হলে এই মুদ্রার দাম পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। ‘২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশ বাজারভিত্তিক ডলারের দাম কার্যকর শুরু করে। এরপর বিশ্বে নানা অর্থনৈতিক সংকট হলেও দেশে ডলারের বাজারের বড় ধরনের কোনো অস্থিরতা দেখা যায়নি। তাই ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে দেখা যেতে পারে তা সমস্যার সমাধানে কাজ করে কি না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ডলার সংকটে আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলা কমেছে। আগস্টের চেয়ে সেপ্টেম্বরে এলসি খোলা কমেছে ১৬ দশমিক ১ শতাংশ। আর গত ৩৫ মাসের মধ্যে সেপ্টেম্বরে এলসি নিষ্পত্তি নেমেছে সর্বনিম্নে। সেপ্টেম্বরে এলসি নিষ্পত্তি ছিল ৪ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২০ সালের অক্টোবরের পর থেকে সর্বনিম্ন। সেপ্টেম্বরে ব্যাংকগুলো ৪ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারের এলসি খুলেছে, যা আগস্টে ছিল ৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডলারের চাপ কমাতে এক বছর ধরে ব্যাংকগুলো এলসি খোলা কমিয়ে দিয়েছে। একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইত্তেফাককে বলেন, এখন যে পেমেন্ট করা হচ্ছে তার একটি বড় অংশ ছয় মাস আগে খোলা ডেফার্ড এলসি পেমেন্ট। সাইট এলসি এখন প্রায় নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ ব্যাংকই সাইট এলসির পরিবর্তে ডেফার্ড এলসি খুলছে উল্লেখ করে ঐ কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকগুলোর কাছে সাইট এলসি খোলার জন্য ডলার নেই।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো দেশের অর্থনীতিতে ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে তার একটা আভাস আমদানি এলসি খোলার পরিমাণ দেখলেই পাওয়া যাবে। ডলারের সংকটের কারণে ক্যাপিটাল মেশিনারি, মধ্যবর্তী পণ্যের জন্য এলসি খোলার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ব্যাংকগুলোরও কিছু করার নেই, কারণ তাদের কাছে পর্যাপ্ত ডলার নেই। শতভাগ মার্জিন দিয়ে ঋণপত্র খুলতে পারছেন না অনেক উদ্যোক্তা। আবার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো শতভাগ মার্জিন রেখে এলসি খুললেও পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংক তা বাতিল করে দিচ্ছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সব ধরনের এলসি যাচাই-বাছাই করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ছাড়া অন্য পণ্যের এলসি খোলা নিরুৎসাহিত করছে। কিন্তু উদ্যোক্তারা অভিযোগ করছেন অনেক জরুরি পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন দিচ্ছে না। রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর এলসি খোলার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে উল্লেখ করে একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, তাদের ডলারের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৫০০-৬০০ মিলিয়ন ডলার কম। এর ফলস্বরূপ তারা সহজে এলসি খুলছেন না।
ব্যাংকাররা বলেন, জুলাই ও আগস্টে ব্যাংকগুলোর ডলারের তারল্য ভালো ছিল। সেপ্টেম্বরে তারল্য কিছুটা কমেছে। ব্যাংকগুলো এখন এলসি খোলার ব্যাপারে খুবই সতর্ক। তাদের মতে, আগামী দিনে ডলারের অবস্থা কেমন হবে তা বোঝা যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে ব্যাংকে চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ডলারের অভাবে সময়মতো কাঁচামাল আমদানি করতে না পারার ঘটনাও ঘটছে। পাশাপাশি এলসি বা ঋণপত্রের দায় পরিশোধের ক্ষেত্রেও অনেক সময় বিলম্ব হচ্ছে। এজন্য দিতে হচ্ছে বাড়তি সুদ। এতে নানাভাবে ব্যবসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। অনেক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান কোনো কোনো ক্ষেত্রে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বাড়তি দামে ডলার কিনে আমদানির ঋণপত্রের দায় শোধ করছে। সব মিলিয়ে সংকটটি এখন নানাভাবে ডালপালা মেলেছে।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, একের পর এক নির্দেশনা জারি করে হুকুমের মাধ্যমে ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। এক জায়গায় নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে আরেক জায়গায় নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন দেখা দেয়। ফলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাটি কাজ করছে না। সরকার যেখানে ডিম আলুর মতো পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে সেটি কার্যকর করতে পারছে না, সেখানে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত ডলারের বাজার কীভাবে দাম বেঁধে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, তা বোধগম্য নয়।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এক দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ, অপর দিকে গ্রাহকের চাপ সবমিলেই তারা বিপাকে পড়েছেন। কারণ বাফেদা রেমিট্যান্সের ডলারের অভিন্ন মূল্য নির্ধারণ করলেও এ মূল্য কেউই মানছে না। বলা হয়েছে রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহ করতে পারবে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা দরে। কিন্তু ব্যাংকভেদে ১১৩ টাকা থেকে ১১৮ টাকা পর্যন্ত দরে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে কেউ কেউ। যারা নিয়ম মানতে যাচ্ছে তারাই পড়ছে বেকায়দায়। কারণ একজন নিয়ম মেনে ১১০ টাকা দরে রেমিট্যান্স আনছে। কিন্তু অন্য ব্যাংক দিচ্ছে ১১৮ টাকা। ফলে নিয়ম মানতে গিয়ে তার ব্যাংক রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে পারছে না।