গাজা নিয়ন্ত্রণকারী ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের অনেকেই নিরাপত্তার জন্য নিজেদের চেহারা দেখান না। তারপরও মাঝে মাঝে তাদের চেহারা দেখা গেছে। চলুন দেখে নেয়া যাক হামাসের নেতৃত্বে কারা রয়েছেন। যাদের কৌশলে বারবার বিস্মিত হয়েছে ইসরায়েল।
মোহাম্মদ দেইফ
মোহাম্মদ দিয়াব আল-মাসরি, যার ডাক নাম ‘আবু খালেদ’ এবং ‘আল-দেইফ’। তিনি হামাস আন্দোলনের সামরিক শাখা ইজ আল-দিন আল-কাসিম ব্রিগেডের নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৫ সালে গাজায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
ফিলিস্তিনিদের কাছে আল দেইফ ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে এবং ইসরায়েলিদের কাছে ‘মৃত্যুর মানুষ’ বা ‘নয়টি জীবন নিয়ে জন্মানো যোদ্ধা’ হিসেবে পরিচিত। তিনি ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজা থেকে জীববিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তিনি অভিনয় এবং থিয়েটার প্রতি আগ্রহের জন্য পরিচিত ছিলেন, আর সেখানে তিনি একটি শিল্পী দল গঠন করেছিলেন।
যখন হামাসের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়, তিনি বিনা দ্বিধায় এই দলে যোগ দেন। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাকে ১৯৮৯ সালে গ্রেফতার করে, আর হামাসের সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে কাজ করার অভিযোগে বিনা বিচারে ১৬ মাস কারাগারে কাটিয়েছেন। কারাবাসের সময় জাকারিয়া আল-শোরবাগি এবং সালাহ শেহাদেহর সাথে মিলে ইসরায়েলি সৈন্যদের বন্দী করার লক্ষ্যে হামাস থেকে আলাদা একটি আন্দোলন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সম্মত হন দেইফ – যা পরে আল-কাসিম ব্রিগেডস হয়ে ওঠে।
দেইফ কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ইজ আল-দিন আল-কাসিম ব্রিগেডস একটি সামরিক সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হয়, যেখানে অন্যান্য নেতাদের সাথে এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দেইফ অগ্রভাগে ছিলেন। দেইফ গাজা থেকে হামাস যোদ্ধাদের ইসরায়েলে প্রবেশের জন্য নির্মিত টানেলের প্রকৌশলী ছিলেন এবং একইসঙ্গে বড় সংখ্যক রকেট উৎক্ষেপণের কৌশল গ্রহীতাদের একজন ছিলেন।
তবে তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হলো হামাসের বোমা প্রস্তুতকারক ইয়াহিয়া আইয়াশকে হত্যার পর প্রতিশোধমূলক অভিযানের ধারাবাহিক পরিকল্পনা এবং তত্ত্বাবধান। বলা হয়, একটি বাসে তার ছোড়া বোমা হামলায় ১৯৯৬ সালের শুরুতে ৫০জন ইসরায়েলি নিহত হয়েছিল এবং ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনজন ইসরায়েলি সেনার বন্দী ও হত্যার সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন।
ইসরায়েল তাকে ২০০০ সালে গ্রেফতার ও বন্দী করে, কিন্তু ‘দ্বিতীয় ইন্তিফাদা’র শুরুতে তিনি বন্দীদশা থেকে পালাতে সক্ষম হন, আর তারপর তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।
দেইফের তিনটি ছবি রয়েছে: একটি খুব পুরনো, দ্বিতীয়টি মুখোশ পরা এবং তৃতীয়টি তার ছায়ার ছবি। তাকে হত্যা করার সবচেয়ে গুরুতর প্রচেষ্টা হয়েছিল ২০০২ সালে, যেটা থেকে তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেও নিজের একটি চোখ হারান। ইসরায়েলের দাবি, তিনি তার একটি পা এবং একটি হাতও হারিয়েছিলেন এবং বেশ কয়েকবার হত্যা প্রচেষ্টার পর বেঁচে থাকলেও তার কথা বলতে অসুবিধা হয়।
গাজা উপত্যকায় ২০১৪ সালে ৫০ দিনেরও বেশি সময় ধরে চলা ইসরায়েলের আক্রমণে দেশটির সেনাবাহিনী দেইফকে হত্যা করতে ব্যর্থ হলেও তার স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে হত্যা করে।
‘দ্য ক্লাউন’ নামক একটি নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি ‘আবু খালেদ’ ডাকনামে পরিচিত হন, যেখানে তিনি মধ্যযুগের প্রথম দিককার উমাইয়া এবং আব্বাসীয় আমলের ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ‘আবু খালেদের’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। আরবি দেইফ শব্দটির অর্থ ‘অতিথি’। এই ডাকনামটি বেছে নেয়ার কারণ ছিল ইসরায়েলিদের হাত থেকে বাঁচতে তিনি একটি জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতেন না আর প্রতি রাতে নতুন কোন জায়গায় ঘুমাতেন।
মারওয়ান ইসা
‘ছায়া মানুষ’ এবং মোহাম্মদ দেইফের ডান হাত নামে পরিচিত মারওয়ান ইসা ইজ আল-দিন আল-কাসিম ব্রিগেডসের ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চিফ এবং হামাস আন্দোলনের রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যুরোর সদস্য। খুব কম বয়সে হামাসের কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ‘প্রথম ইন্তিফাদা’ চলাকালীন ইসরায়েলি বাহিনী তাকে আটক করে পাঁচ বছর কারাগারে রেখেছিল।
ইসরায়েল তাকে ‘কথা নয়, কাজের লোক’ হিসাবে বর্ণনা করে এবং বলে যে তিনি এতটাই চালাক যে কোন ‘প্লাস্টিককেও ধাতুতে পরিণত করতে পারেন’।
তিনি একজন বিশিষ্ট বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিতি পেলেও ক্রীড়া তার পেশা ছিল না। ১৯৮৭ সালে হামাস আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অভিযোগে ইসরায়েল তাকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রেফতার করে এবং ২০০০ সালের আল-আকসা ইন্তিফাদার আগ পর্যন্ত তাকে মুক্তি দেয়া হয়নি।
কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ইসা আল-কাসিম ব্রিগেডসের সামরিক ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
আন্দোলনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে তিনি ইসরায়েলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় জায়গা করে নেন। ২০০৬ সালে দেইফ এবং আল-কাসিম ব্রিগেডসের প্রধান নেতাদের সঙ্গে সাধারণ কর্মীদের একটি বৈঠকের সময় ইসরায়েলিরা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। তিনি আহত হলেও তাকে নির্মূল করার ইসরায়েলের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।
২০১৪ এবং ২০২১ সালে গাজা আক্রমণের সময় ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো তার বাড়িও দুবার ধ্বংস করেছে। সেই আক্রমণে তার ভাই মারা যান।২০১১ সালে ইসরায়েলি সেনা গিলাদ শালিতের বিনিময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দীদের অভ্যর্থনা করার সময় তোলা একটি গ্রুপ ছবির আগে তার চেহারা কারো জানা ছিল না।
নম-দে-গুয়েরে আবু আল-বারা নামেও পরিচিত ইসার ২০১২ সালের ‘শেল স্টোনস’ থেকে ২০২৩ সালের ‘আল-আকসা ফ্লাড’ অভিযান পর্যন্ত বিভিন্ন যুদ্ধের পরিকল্পনায় ভূমিকা স্পষ্ট। এতে মাঠপর্যায়ের শক্তি, গোয়েন্দা ও প্রযুক্তি বাহিনী, সংগঠিত ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার পরিধি এবং বসতি ও নিরাপত্তা সদর দফতরের উপর বিশেষ নজর দেওয়া- সবকিছুই তার জড়িত থাকার ইঙ্গিত দেয়।
ইয়াহিয়া সিনওয়ার
হামাস আন্দোলনের নেতা এবং গাজা উপত্যকার রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান ইয়াহিয়া ইব্রাহিম আল-সিনওয়ার ১৯৬২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ‘মাজদ’ নামে পরিচিত হামাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা। এটি মূলত সন্দেহভাজন ইসরায়েলি এজেন্টদের বিষয়ে তদন্ত পরিচালনা এবং ইসরায়েলি গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার কর্মকর্তাদের ট্র্যাক করার মতো অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয় পরিচালনা করে।
সিনওয়ারকে তিনবার গ্রেফতার করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৯৮২ সালে প্রথমবার আটকের পর ইসরায়েলি বাহিনী তাকে চার মাস প্রশাসনিক কারাগারে রাখে। ১৯৮৮ সালে সিনওয়ারকে তৃতীয়বার গ্রেফতার করা হয় এবং চারটি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সিনওয়ার যখন কারাবাসে ছিলেন, তখন ইসরায়েলি সৈনিক গিলাদ শালিতের ট্যাঙ্কটি হামাসের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার হয় এবং ওই ইসরায়েলি সৈন্যকে জিম্মি করা হয়।
শালিতকে বলা হত ‘সবার মানুষ’, তাই ইসরায়েলকে তার মুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করতে হয়েছিল। ‘মুক্তির আনুগত্য’ নামে একটি বন্দী বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে এটা ঘটে, যেখানে ফাতাহ এবং হামাস আন্দোলনের অনেক বন্দীদের সঙ্গে ইয়াহিয়া সিনওয়ারও ছিলেন। ২০১১ সালে তিনি মুক্তি পান।
মুক্তির পর সিনওয়ার হামাস আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং এর রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য হিসাবে তার অবস্থানে ফিরে আসেন।২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিনওয়ারের নাম ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের’ কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ইসমাইল হানিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে ২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী সিনওয়ার গাজা উপত্যকার রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান নির্বাচিত হন।
আব্দুল্লাহ বারঘৌতি
বারঘৌতি ১৯৭২ সালে কুয়েতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৯০ সালে দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের পর জর্ডানে চলে যান। তিনি জর্ডানের নাগরিকত্ব নেনে। দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছরের জন্য ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন তিনি। এখানেই বিস্ফোরক তৈরি করতে শিখেছিলেন এই হামাস নেতা। ফিলিস্তিনে প্রবেশের অনুমতি পাওয়ার কারণে তিনি পড়াশোনা শেষ করেননি।
একদিন চাচাতো ভাই বিলাল আল-বারগৌথিকে পশ্চিম তীরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে যায় এবং তার দক্ষতা দেখানোর আগ পর্যন্ত তার আশেপাশের কেউই বিস্ফোরক তৈরির বিষয়ে তার দক্ষতা সম্পর্কে জানত না।
বিলাল তার কমান্ডারকে এ বিষয়ে বলার পর আবদুল্লাহ বারগৌথিকে কাসিম ব্রিগেডসের দলে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।
ডেটোনেটর তৈরির পাশাপাশি আলু থেকে বিস্ফোরক যন্ত্র এবং বিষাক্ত পদার্থ তৈরিতে কাজ করেছিলেন এই ‘ইঞ্জিনিয়ার’। বারঘৌতি তার শহরের একটি গুদামে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের জন্য বিশেষ কারখানা স্থাপন করেছিলেন।
ইসরায়েলি বিশেষ বাহিনী ২০০৩ সালে আকস্মিকভাবে বারঘৌতিকে গ্রেফতার করার পর তাকে তিন মাস জিজ্ঞাসাবাদে রাখা হয়। বারঘৌতিকে কয়েক ডজন ইসরায়েলির মৃত্যুর জন্য দায়ী দাবি করে ইসরায়েল।
তাকে ৬৭ টি যাবজ্জীবন এবং ৫ হাজার ২০০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় যা ইসরায়েলের ইতিহাসে দীর্ঘতম সাজা। এটি সম্ভবত মানব ইতিহাসেও সর্বোচ্চ। তাকে কিছু সময়ের জন্য নির্জন কারাগারে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তার অনশনে যাবার কারণে এটি বন্ধ করা হয়।
বারঘৌতিকে ‘ছায়ার রাজপুত্র’ নামে ডাকা হয়। কারণ কারাগারে থাকার সময় তিনি এই নামে এই বই লিখেছিলেন। বইটিতে তিনি তার জীবন এবং অন্যান্য বন্দীদের সাথে যে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন তার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। কীভাবে তিনি ইসরায়েলি সামরিক চেকপোস্টের মাধ্যমে বিস্ফোরক পেয়েছিলেন, কীভাবে অনেক দূরে বোমা হামলা পরিচালনা করেছিলেন সে বিষয়ে বর্ণনা দিয়েছেন।
ইসমাইল হানিয়া
আবু আল-আবদ ডাকনামের ইসমাইল আবদেল সালাম হানিয়া জন্মেছিলেন ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে। তিনি হামাস আন্দোলনের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান এবং ফিলিস্তিন সরকারের দশম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ইসরায়েল ১৯৮৯ সালে তাকে তিন বছর বন্দী করে রাখে। এরপর তাকে মারজ আল-জুহুর নামের ইসরায়েল এবং লেবাননের মধ্যকার একটি নো-ম্যানস-ল্যান্ডে নির্বাসিত করা হয়। সেখানে তিনি ১৯৯২ সালে বেশ কয়েকজন হামাস নেতার সাথে অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে একটি পুরো বছর কাটিয়েছিন।
নির্বাসনে থাকার পর তিনি গাজায় ফিরে আসেন এবং ১৯৯৭ সালে হামাস আন্দোলনের আধ্যাত্মিক নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের অফিসের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন, যা তার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে। ২০০৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি হামাস তাকে ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করে এবং একই মাসের ২০ তারিখ তাকে নিযুক্ত করা হয়।
এক বছর পর ফিলিস্তিনের জাতীয় কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হানিয়াকে পদ থেকে বরখাস্ত করেন। কারণ ইজ আল-দিন আল-কাসিম ব্রিগেডস গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে আব্বাসের ফাতাহ আন্দোলনের প্রতিনিধিদের বহিষ্কার করে। সেই সহিংসতায় অনেকে মারা যায়।
হানিয়া তার বরখাস্তকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘তার সরকার দায়িত্ব অব্যাহত রাখবে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি তাদের জাতীয় দায়িত্ব ছেড়ে যাবে না।’
হানিয়া এর পর বেশ কয়েকবার ফাতাহ আন্দোলনের সাথে সমঝোতার আহ্বান জানিয়েছে। ২০১৭ সালের ৬ মে তিনি হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর হানিয়েকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে।
খালেদ মেশাল
খালেদ মেশাল ‘আবু আল-ওয়ালিদ’ ১৯৫৬ সালে সিলওয়াদের পশ্চিম তীরের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারসহ কুয়েতে চলে যাওয়ার আগে তিনি সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। আর কুয়েতে যাবার পর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন।
মেশাল হামাস আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য। ১৯৯৬ এবং ২০১৭ সালের মধ্যে তিনি রাজনৈতিক ব্যুরোর সভাপতিত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০০৪ সালে শেখ আহমেদ ইয়াসিনের মৃত্যুর পর এর নেতা নিযুক্ত হন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ১৯৯৭ সালে মেশালকে হত্যার জন্য গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের প্রধানকে নির্দেশ দেন। তিনি এই হত্যাকাণ্ড চালানোর জন্য একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে বলেছিলেন।
মোসাদের দশজন এজেন্ট কানাডার জাল পাসপোর্ট নিয়ে জর্ডানে প্রবেশ করে সেই সময়ে জর্ডানের নাগরিক খালেদ মেশালকে রাজধানী আম্মানের একটি রাস্তায় হাঁটার সময় বিষাক্ত পদার্থ দিয়ে ইনজেকশন দেওয়া হয়। জর্ডানের কর্তৃপক্ষ হত্যা প্রচেষ্টার সন্ধান পায় এবং জড়িত দুই মোসাদ সদস্যকে গ্রেফতার করে।
জর্ডানের প্রয়াত রাজা হুসেইন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর কাছে মেশালকে যে বিষাক্ত পদার্থের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল তার প্রতিষেধক চান, কিন্তু নেতানিয়াহু প্রথমে সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের হস্তক্ষেপে নেতানিয়াহুকে প্রতিষেধক সরবরাহ করতে বাধ্য করায় এই হত্যা প্রচেষ্টা একটি রাজনৈতিক মাত্রা নেয়।
মেশাল ২০১২ সালের সাত ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো গাজা উপত্যকায় যান। ১১ বছর বয়সে তিনি চলে যাওয়ার পর ফিলিস্তিনি অঞ্চলে এটাই তার প্রথম সফর ছিল। রাফাহ ক্রসিংয়ে পৌঁছানোর পর বিভিন্ন দল ও জাতীয় পর্যায়ের ফিলিস্তিনি নেতারা তাকে অভ্যর্থনা জানায় এবং গাজা শহরে পৌঁছনো পর্যন্ত ফিলিস্তিনিরা রাস্তায় জড়ো হয়ে তাকে অভিবাদন জানায়।
মাহমুদ যাহার
মাহমুদ জাহার ১৯৪৫ সালে গাজার একজন ফিলিস্তিনি বাবা এবং একজন মিশরীয় মায়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন এবং মিশরের ইসমাইলিয়া শহরে তার শৈশব কাটান।
গাজাতেই তিনি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ১৯৭১ সালে কায়রোর আইন শামস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেনারেল মেডিসিনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৭৬ সালে জেনারেল সার্জারিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। স্নাতকের পর তার রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাকে বরখাস্ত করার আগ পর্যন্ত তিনি গাজা এবং খান ইউনিসের হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কর্তব্যরত ছিলেন।
জাহারকে হামাসের অন্যতম প্রধান নেতা এবং আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হামাস আন্দোলনের প্রতিষ্ঠার ছয় মাস পর ১৯৮৮ সালে মাহমুদ জাহারকে ছয় মাস ইসরায়েলি কারাগারে রাখা হয়েছিল। ১৯৯২ সালে ইসরায়েল থেকে মারজ আল-জুহুরে নির্বাসিত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিও ছিলেন, যেখানে তিনি পুরো এক বছর কাটিয়েছেন।
২০০৫ সালে হামাস আন্দোলন আইনসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর থেকে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ফিলিস্তিন সরকারকে বরখাস্ত করার আগ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল হানিয়ার সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন যাহার।
ইসরায়েল ২০০৩ সালে গাজা শহরের রিমাল এলাকায় যাহারের বাড়িতে এফ-১৬ বিমান থেকে অর্ধটন ওজনের একটি বোমা ফেলে তাকে হত্যার চেষ্টা করে। হামলায় তিনি সামান্য আহত হলেও তার বড় ছেলে খালেদের মৃত্যু হয়। ২০০৮ সালের ১৫ জানুয়ারি গাজার পূর্বে ইসরায়েলি অভিযানে নিহত ১৮ জনের একজন ছিলেন তার দ্বিতীয় ছেলে হোসাম। হোসাম কাসিম ব্রিগেডের সদস্যও ছিলেন।
‘দ্য প্রবলেম অফ আওয়ার কনটেম্পরারি সোসাইটি… আ কোরআনিক স্টাডি’, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর লেখা বইয়ের প্রতিক্রিয়ায় ‘নো প্লেস আন্ডার দ্য সান’ এবং ‘অন ফুটপাথ’ নামের উপন্যাসসহ যাহারের বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক এবং সাহিত্যিক কাজ রয়েছে।