খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা ও ছাড় দেওয়া সত্ত্বেও গত ১৪ বছরে খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ প্রায় সাত গুণ বেড়েছে। গত রোববার (১ অক্টোবর) বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ-সংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ এখন বেড়ে এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ ঋণের ১০.১১ শতাংশই এখন খেলাপি।
অথচ বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় ২০০৯ সালে দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। তারও এক দশক আগে ১৯৯০ সালে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল চার হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা।
তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল গত মে মাসে জানিয়েছিল বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের এই পরিমাণ আরও বেশি, প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার মতো। কারণ সন্দেহজনক ঋণ, আদালতের আদেশে খেলাপি স্থগিতাদেশ থাকা ঋণ, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণকেও তারা খেলাপি দেখানোর পক্ষে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা ব্যাংকিং খাতের অবনতির মূল কারণ হিসেবে খেলাপি ঋণকেই চিহ্নিত করছেন অর্থনীতিবিদরা, যা দেশের অর্থনীতিকে স্তব্ধ করে এক প্রকার দেউলিয়া দশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে তারা জানাচ্ছেন।
নানা সুবিধা দিয়েও লাভ হয়নি
ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যেসব শর্ত দেয় তার মধ্যে অন্যতম হলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য সুদসহ ঋণের সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ করা। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, নির্দিষ্ট সময় পর ঋণগ্রহীতা যদি ঋণ বা ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করে, তখন ওই অনাদায়ী ঋণকে খেলাপি ঋণ বলা হয়।
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকায়, অনাদায়ী ঋণ আদায়ে ২০১৫ সাল থেকে ঋণ খেলাপিদের নানা ধরনের সুবিধা ও বড় বড় ছাড় দিয়ে আসছে সরকার।
আবার আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকগুলো শর্তের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার শর্ত দিয়েছিল। বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ ২০২৬ সালের মধ্যে পাঁচ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকে ১০ শতাংশের নিচে নামানোর শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের বেশি। সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হারও নির্ধারিত মাত্রার ওপরে।
ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে আগামী ৫ অক্টোবর আইএমএফের প্রতিনিধিদের দেশ আসার কথা রয়েছে। এমন অবস্থায় খেলাপি ঋণ কম কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক নানা নীতির ঘোষণা দেয়। সবশেষ মেয়াদী ঋণের কিস্তির অর্ধেক শোধ করতে পারলেই তাদের আর ঋণখেলাপি বলা হবে না – এমন সুযোগও দেয়া হয়। কিন্তু বার বার সুবিধা দেওয়া হলেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনীতে সেই সুযোগ যেন আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
চলতি বছরে জাতীয় সংসদে ওই আইনের সংশোধনীতে বলা হয়েছে, এখন থেকে খেলাপিরাও ঋণ নেওয়ার সুযোগ পাবেন। আগে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলে তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পাওয়ার সুযোগ ছিল না। নতুন আইনের কারণে খেলাপিদের নতুন ঋণ পেতে সমস্যা হবে না। ফলে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ নেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অর্থনীতির ওপর চক্রাকারে আঘাত
অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, খেলাপি ঋণ থাকা মানে, ব্যাংক ওই বিনিয়োগ থেকে কোনো লভ্যাংশ পায় না, ব্যাংকের মুনাফা কমে যায়। ব্যাংকে টাকার পরিমাণ কমে গেলে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়। ফলে ব্যাংকের নতুন করে ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। এতে নতুন করে বিনিয়োগ কমে যায়, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে। ফলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এক কথায় খেলাপি ঋণের প্রভাবে ব্যাংকিং খাত ও রিজার্ভসহ সবধরনের আর্থিক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, ব্যাংকের টাকা অর্থনীতিতে ‘জ্বালানির মতো’ কাজ করে। এই খাতের বড় অংকের টাকা ব্যবস্থাপনার বাইরে চলে গেলে গোটা অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
তিনি জানান, ব্যাংকের মুনাফার ওপর যদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তাহলে স্বাভাবিকভাবে সরকার ব্যাংকের থেকে কম কর পায়। আর সরকার কম কর পেলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় খাতে ব্যয় কমে যাবে। যা এটি চক্রাকারে উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে।
এছাড়া অবকাঠামো উন্নয়নেও সরকার ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ করতে পারবে না, বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করতে হবে।
সেইসাথে যে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনছেন তাদের শেয়ারের দাম কমে যাচ্ছে। যার প্রভাব ব্যাংকিং খাতে এসে পড়ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
মুদ্রাস্ফীতি
অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশের মতে খেলাপি ঋণ মানুষের জীবনে প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ দুইভাবেই প্রভাব ফেলে। উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ব্যাংক ঋণ দিলেও এই ঋণের অর্থ উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার না হওয়ায় তা সরাসরি মুদ্রাস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। তিনি জানান, ‘যত বেশি ঋণ খেলাপি হবে, ততই সরকারের বাজেটে ঘাটতি হবে। খেলাপিদের চাপে ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিতে পারবে না।’
‘সুতরাং ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিতে বেশি টাকা ছাপাবে। তখন সেটাও পরোক্ষভাবে মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে।’
তার মতে, ঋণের অর্থ যদি উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার হতো তাহলে টাকার বিপরীতে পণ্য বাজারে থাকতো। এতে মুদ্রাস্ফীতি হতো না।
ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমেছে
ঋণগ্রহীতারা ঋণ শোধ করতে না পারায় পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কারণ তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। শিল্প ও এসএমই খাতে ঋণের প্রবাহ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। এতে ভালো ঋণগ্রহীতারা ঋণ পাচ্ছেন না।
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ বলেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা কৃষকরা তাদের প্রয়োজনীয় ঋণ পাচ্ছে না। তারা মূলধন না পাওয়ার কারণে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে সরবরাহ ব্যবস্থায় টান পড়ায় দ্রব্যমূল্যের ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সেটার প্রভাব গিয়ে পড়ছে পণ্যমূল্যের ওপর। এ কারণে সাধারণ মানুষকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। অর্থাৎ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও পরোক্ষভাবে খেলাপি ঋণ দায়ী।
সুদজনিত সংকট
খেলাপি ঋণের প্রভাবে ব্যাংকের সাধারণ আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা ব্যাংকে টাকা রাখলে লাভ পাচ্ছেন কম, ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ পোষাতে আমানতকারীদের লাভের হার কমিয়ে দিচ্ছেন।
অপরদিকে ভালো ব্যবসায়ীরাও ঋণ পেতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছেন। তাদের ওপর বেশি সুদ চাপানো হচ্ছে। অথচ এই ব্যবসায়ী যদি ঋণ পেলে দেশের উৎপাদন বাড়ত বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সাধারণ ব্যবসায়ীকে ঋণ দিতে গিয়ে ওই খেলাপি ঘাটতি পূরণের জন্য তাদের কাছে বেশি সুদ চাইছে ব্যাংক। এতে ভালো ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এই বাড়তি সুদ পোষাতে পণ্যের দাম বেশি রাখতে বাধ্য হচ্ছেন বিক্রেতারা। অর্থাৎ ঘুরে ফিরে সাধারণ মানুষকে সেই বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। এমনকি ব্যাংকের ক্ষুদ্র শেয়ারহোল্ডাররাও প্রাপ্ত লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এমএম আকাশের মতে, ‘ভালো ব্যবসায়ীরা ঋণ পাচ্ছে না। সুদের হারটাও সরকার বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা।’
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, ‘যদি খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি থাকে তাহলে স্বাভাবিকভাবে ব্যাংক নাগরিকদের কাছে থেকে যে আমানত বা জমা নিচ্ছে তাদেরকে সেই জমা বাবদ আগের চাইতে কম হারে সুদ দেবে। আবার ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও আগের চাইতে বেশি সুদ রাখবে। এতে বিনিয়োগ কমে যাবে।’
অর্থাৎ যে ঋণের টাকা আর ফেরত আসবে না সেটার খরচকে এভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে তিনি জানান।
কর বৃদ্ধি
খেলাপি ঋণ সরকারের কর ব্যবস্থাপনাকেও প্রভাবিত করে। অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশের মতে, খেলাপি ঋণের ফলে সরকারের বাজেটে যে ঘাটতি হবে, তখন ভারসাম্য করার জন্য সরকারের কর বৃদ্ধি করা ছাড়া আর উপায় থাকবে না। সেটিও হবে পরোক্ষ কর যা সব শ্রেণি পেশার মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
আকাশ বলেন, ‘যদি প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে ওই খেলাপিদের থেকে কিছু টাকা আদায় করা যেতো তাহলে লাভ হতো। কিন্তু সরকার নিচ্ছে পরোক্ষ কর বা ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স। তার মানে একজনের দোষের বোঝা বহন করবে নির্দোষ সাধারণ মানুষ। সরকার তার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এই মানুষগুলোর ওপর ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে।’
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানান, যদি সরকারের ব্যয় করার বা বিনিয়োগের চাহিদা থাকে এবং যেখানে ন্যায্য কর পাওয়ার কথা সেখান থেকে কর না পায় তাহলে স্বাভাবিকভাবে সরকার অন্য খাতে করের পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে। তখন প্রত্যক্ষ করের চেয়ে পরোক্ষ করের ওপর বোঝা বাড়াবে। অর্থাৎ যাদের কর দেয়ার কথা ছিল তারা দেবে না। গরিব বড়লোক নির্বিশেষে সবাই এই বোঝা বহন করবে।
বিদেশে অর্থপাচার
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, খেলাপি ঋণ বা মন্দ ঋণের সাথে টাকা পাচারের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তার মতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই টাকাগুলোর একটা বিরাট অংশ বৈদেশিক মুদ্রায় বদলে নিয়ে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। ফলে তা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও চাপ তৈরি করছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের আমানতের ওই টাকা দেশের কোন উপকারে আসে না।
এক কথায় এই খেলাপি ঋণের প্রভাবে উৎপাদন হচ্ছে, ব্যাংক টাকাও ফেরত পাচ্ছে না। উপরন্তু টাকা বিদেশ পাচার হয়ে যাচ্ছে, যা অর্থনীতিকে চক্রাকারে আঘাত করছে।
এদিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘অর্থনৈতিক সংকট ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণ বাড়ার কয়েকটি কারণের কথা তুলে ধরা হয়। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো— রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক পরিচালকদের নিয়োগ, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ অনুমোদন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার অভাব, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়া। সেই সাথে রয়েছে, স্বার্থান্বেষীদের পক্ষে ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের সংশোধনী, আর্থিক ঋণ আদালত আইনের দুর্বলতা, দেউলিয়া বিষয়ে আইনে ফাঁকফোকর, তথ্যের মান নিয়ে সমস্যা, সঠিক তথ্যের অনুপস্থিতি, ঋণ পাওয়ার জন্য মিথ্যা তথ্য, জাল নথি ও ভুয়া কোম্পানির পরিচয়।
বর্তমানে দেশের আদালতগুলোয় খেলাপি ঋণের অভিযোগে প্রায় ৭২ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে বলে জানা গিয়েছে।