আজারবাইজান সামরিক আক্রমণ চালিয়ে বিচ্ছিন্ন নাগোরনো-কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার পর অঞ্চলটি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন শত শত জাতিগত আর্মেনিয়ান। ‘বিভিন্ন ধরনের শঙ্কার’ কারণে আজারবাইজানের নিয়ন্ত্রণে থাকতে অনিচ্ছুক এসব আর্মেনিয়ান চলে যাচ্ছেন আর্মেনিয়ায়।
সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আজারবাইজান নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কয়েকদিন পর শত শত জাতিগত আর্মেনিয়ান সেখান থেকে আর্মেনিয়ায় পালিয়েছেন। আর্মেনিয়ান সরকার রোববার রাতে বলেছে, নাগোরনো-কারাবাখ থেকে মোট ১ হাজার ৫০ জন লোক দেশে প্রবেশ করেছে।
আর্মেনিয়া বলেছে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় থেকে সংঘাতময় এই অঞ্চলে গত সপ্তাহে আজারবাইজানের সামরিক বিজয়ের পরে তারা তাদের (জাতিগত আর্মেনিয়ান) গ্রহণ করতে প্রস্তুত।
আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান রোববার বলেছেন, দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলের প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার বেসামরিক নাগরিক আর্মেনিয়া চলে আসবেন বলে তিনি আশা করছেন। কারণ তারা আজারবাইজানের অংশে থাকতে চায় না এবং ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞের’ ভয়ে শঙ্কিত।
তিনি বলেন, ‘নাগোরনো-কারাবাখের আর্মেনীয়রা তাদের মাতৃভূমি ছেড়ে চলে আসাকেই একমাত্র উপায় হিসেবে দেখবে এবং সেই সম্ভাবনাই বাড়ছে।’
রাশিয়ার তাস নিউজ এজেন্সি অনুসারে, পাশিনিয়ান আরও বলেছেন- আর্মেনিয়া ‘নাগোরনো-কারাবাখ থেকে আমাদের ভাই ও বোনদের স্নেহের সাথে স্বাগত জানাবে’। আর্মেনিয়ান এই নেতা মস্কোর সঙ্গে বিভেদেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন কালেক্টিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সিএসটিও) তার দেশকে রক্ষা করার জন্য ‘যথেষ্ট ছিল না’।
যদিও সিএসটিও চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী সদস্যরা বাইরের আক্রমণ থেকে একে অপরকে রক্ষা করার অঙ্গীকার করে থাকে। তারপরও ইউক্রেনের যুদ্ধে জর্জরিত রাশিয়া আর্মেনিয়ার সহায়তায় এগিয়ে আসতে অস্বীকার করেছে।
এদিকে নাগোরনো-কারাবাখের জাতিগত আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠীর ভাগ্য কোন দিকে যাবে তা মস্কো, ওয়াশিংটন এবং ব্রাসেলসে উদ্বেগ বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে আল জাজিরা।
গত সপ্তাহে ককেশাস অঞ্চলের দেশ আজারবাইজানের বিতর্কিত নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চলে সামরিক অভিযান চালায়। বিতর্কিত এই ভূখণ্ডের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বাকুর সামরিক অভিযান শুরু করার ২৪ ঘণ্টা পর নাগোরনো-কারাবাখের আর্মেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ এবং অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে রাজি হয়।
গত বুধবার স্থানীয় সময় দুপুর ১টা থেকে ওই চুক্তি কার্যকর হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, নাগোরনো-কারাবাখে আর্মেনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীকে নিরস্ত্র এবং ভেঙে দেওয়া হবে।
এরপর আজারবাইজানীয় প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ গত বৃহস্পতিবার কারাবাখে নিজেদের বিজয় ঘোষণা করে বলেন, এই অঞ্চলটি সম্পূর্ণভাবে বাকুর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং স্বাধীন নাগোরনো-কারাবাখ প্রতিষ্ঠার ধারণাটি শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে।
আল জাজিরা বলছে, প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ এই অঞ্চলে বসবাসরত জাতিগত আর্মেনিয়ানদের অধিকার ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু বছরের পর বছর ধরে চলা সংঘাতে নানা ঘৃণামূলক বক্তব্য এবং সহিংসতা সেখানে গভীর দাগ ফেলেছে।
মুসলিম প্রধান আজারবাইজান বলেছে, আর্মেনীয়রা – যারা খ্রিস্টান – তারা চাইলে নাগোরনো-কারাবাখ থেকে চলে যেতে পারে।
মূলত আজারবাইজানের ভূখণ্ড হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জাতিগত আর্মেনীয় ছিটমহল নাগোরনো-কারাবাখ ঘিরে কয়েক মাস ধরে দুই দেশের মাঝে উত্তেজনা চলছিল। সম্প্রতি বিতর্কিত ওই ভূখণ্ডে মাইন বিস্ফোরণ ও অন্য এক ঘটনায় আজারবাইজানের ১১ পুলিশ সদস্য ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিলেন।
আর আর্মেনিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন ওই অঞ্চলে গত মঙ্গলবার আজারবাইজানের সামরিক বাহিনীর অভিযান পরিচালনার খবর পাওয়া যায়। আর সেই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যেই এবার কারাবাখ ছাড়তে শুরু করেছেন শত শত জাতিগত আর্মেনিয়ান।
বিতর্কিত নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান কয়েক দশক ধরে বিবাদে লিপ্ত রয়েছে। নাগোরনো-কারাবাখ আজারবাইজানের ভূখণ্ডের ভেতরে অবস্থিত হলেও ১৯৯৪ সালের এক যুদ্ধের পর থেকে আর্মেনিয়ার সমর্থনে জাতিগত আর্মেনীয় বাহিনী ওই অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল।
ইতোমধ্যে নাগোরনো-কারাবাখ ঘিরে দুই প্রতিবেশী আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়া অন্তত দুবার যুদ্ধে জড়িয়েছে। ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর প্রথমবার যুদ্ধে জড়ায় দেশ দুটি।
সাবেক সোভিয়েত এ দুই রাষ্ট্র বিতর্কিত নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে ২০২০ সালে ফের প্রাণঘাতী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। দুই দেশের সৈন্যদের হামলা-পাল্টা হামলায় সেই যুদ্ধে উভয়পক্ষের সাড়ে ৬ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
যুদ্ধের পর আর্মেনিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া নাগোরনো-কারাবাখে কয়েক হাজার শান্তিরক্ষী মোতায়েন করে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সেখান থেকে শান্তিরক্ষীদের পরে প্রত্যাহার করে নেয় মস্কো।