গ্রামের মসজিদে মাইকিং করে গরু-ছাগলকে সরকারি ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। জেলা শহর থেকে সরকারি পশু চিকিৎসক এসেছেন এমন খবর জানতে পেরে গরু-ছাগলকে নিয়ে গিয়ে ভ্যাকসিন দেয় গ্রামবাসী। কিন্তু ভ্যাকসিন দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মরতে শুরু করে ভ্যাকসিন দেওয়া গরু। এমনকি তিন দিনের ব্যবধানে মোট ১২টি গরুর মৃত্যু হয়। এছাড়া অসুস্থ হয়েছে অর্ধশতাধিক গরু।
এ ঘটনায় আতঙ্কে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের যাদুপুর গ্রামের খামারি ও বাড়িতে গরু লালন-পালনকারীরা।
স্থানীয়রা বলছেন, এক হাতুড়ে পশু চিকিৎসকের পরামর্শে সরকারি ভ্যাকসিন দেওয়ার পরই এই ঘটনা ঘটেছে। সেই হাতুড়ে চিকিৎসকের ফাঁদে পড়েই সর্বনাশ হয়েছে তাদের। গত রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) ভ্যাকসিন দেওয়ার পর রাত পার হতে না হতেই সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকেই গরুর অসুস্থতা দেখা দেয়। আস্তে আস্তে এক এক করে বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সকাল পর্যন্ত ১২টি গরু মারা গেছে।
গ্রামবাসী ও ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নাইমুল হকের ভাতিজা মাইনুল ইসলাম নিজেকে সরকারি পশু চিকিৎসক হিসেবে এলাকায় পরিচয় দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাকে সঙ্গে নিয়ে এর আগেও একাধিকবার ভ্যাকসিন কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। সেই থেকে স্থানীয়রা তাকে সরল মনে বিশ্বাস করে ভ্যাকসিন দেওয়ার অনুমতি দেয়। আর সরকারি এই ভ্যাকসিন না দিলে পরে তিন হাজার টাকা দিয়ে সরকারিভাবে ভ্যাকসিন দিতে হবে বলে একাধিক ব্যক্তিকে জানান।
জানা যায়, ভ্যাকসিন দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই শুরু হয় গরুগুলোর অতিরিক্ত জ্বর, পেট ফাপা, মুখ দিয়ে লালা ঝড়া। ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতে গরু মারা যেতে শুরু করে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর দাবি, সুষ্ঠু তদন্ত করে অপরাধীর কঠোর শাস্তি প্রদান করবে স্থানীয় প্রশাসন। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সরকারের কাছে আর্থিকভাবে সহযোগিতা চান।
যাদুপুর গ্রামের ইমাম হাসান বলেন, ভ্যাকসিন দেওয়ার একদিন পর একটি এবং দ্বিতীয়দিন আরেকটি গরু মারা যায়। গরুগুলো হারিয়ে আমরা দিশেহারা হয়ে গেছি। আমাদের গ্রামে যারা ভ্যাকসিন দিয়েছে তাদের সবার গরু গুরুতর অসুস্থ। ঋণের টাকায় গরু কিনে লালন-পালন করছিলাম, এখন সব শেষ হয়ে গেল।
বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের যাদুপুর জোলাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ইব্রাহীম আলী ঋণ করে গরু কিনেছিল। সেই গরুটি হাতুড়ে ডাক্তারের ভ্যাকসিনের কারণে সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় মারা গেছে। তিনি বলেন, এখন হা হুতাশ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ঋণের টাকা কেমন করে পরিশোধ করব জানি না। আমরা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই এবং অপরাধীর কঠোর শাস্তি দাবি করছি।
বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মেহেদী হাসান ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের কাছে সহায়তার দাবি করেন। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ১২টি গরু মারা গেছে, এছাড়া অর্ধশতাধিক গরু অসুস্থ। আমি চাই, সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে প্রশাসন।
সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ (ভারপ্রাপ্ত) কর্মকর্তা ডা. মো. আখতারুজ্জামান জানান, আমরা ভ্যাকসিনের কারণে গরু মারা যাওয়ার খবরটি পেয়ে রাতেই স্থানীয় প্রশাসনসহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। গরুগুলো কি কারণে মারা গেছে সেটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য জয়পুরহাট থেকে একটি বিশেষজ্ঞ দল ময়নাতদন্ত ও নমুনা সংগ্রহের জন্য একটি টিম এসেছেন। সেই টিম নমুনা সংগ্রহ করেছে। সেগুলো ল্যাবে পরীক্ষা করলে, কি কারণে গরুগুলো মারা গেছে তা জানা সম্ভব হবে।
ঘটনার বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নাইমুল হকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। আরেক অভিযুক্ত হাতুড়ে পশু চিকিৎসক মাইনুল ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাছমিনা খাতুন বলেন, স্থানীয় সূত্রে গরু মারা যাওয়ার বিষয়টি আমরা জানতে পেরে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক স্যারের নেতৃত্বে আমি, এসি ল্যান্ড, ডিএলও রাতেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। আমরা জানতে পেরেছি, সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের উপ-সহকারী কর্মকর্তা নাইমুল ইসলামের ভাতিজা মাইনুল ইসলাম অবৈধভাবে ভ্যাকসিনগুলো নিয়ে প্রয়োগ করেছিল। সেই কর্মকর্তার দায়িত্বের অবহেলার কারণে তার ভাতিজার বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ডিএলওকে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নাইমুল ইসলামকে শোকজ করার জন্য বলা হয়েছে। ল্যাব টেস্টে যদি ভ্যাকসিনে কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। আর যদি ভ্যাকসিন দেওয়ার কারণে গরু মারা যায়, তাহলে সেই ব্যক্তির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত গরুর মালিকদের দেওয়া হবে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান গরু মারা যাওয়ার ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে প্রমাণিত হলে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নাইমুল হককে শোকজ করার জন্য। এছাড়া এই ঘটনাটি প্রাণিসম্পদ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তা নাইমুল ইসলামের মোবাইল ফোনে কল করলে তিনি রিসিভ না করায় ও অফিসে গিয়েও না পাওয়ায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।