প্যাডের উপরে মঙ্গলবারের তারিখ (১৯/০৯/২০২৩) উল্লেখ করে লেখা ছিল, ‘মানুষ বাঁচে তার সম্মানে। আজ মানুষের সামনে যেহেতু আমার সম্মান নেই, এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আমার কোন অধিকার নেই। আমার মৃত্যুর দায়ভার একান্ত আমার। স্যরি মা। বাড়ি থেকে তোমাকে দিয়ে আসা কথা রাখতে পারলাম না। আমার জীবন নিয়ে হতাশ। ফিরোজ- রাত:১২টা ৩’
লেখার দ্বিতীয় অংশে ছিল, আমার ওয়ালেটের কার্ডে কিছু টাকা আছে। বন্ধুদের কাছে অনুরোধ রইলো মায়ের হাতে দিতে। কার্ডের পাসওয়ার্ড ‘****’। আমার ফোনের লক খুলে দিয়ে গেলাম। আমার লাশের পোস্টমর্টেম না করে যেন বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কোনোরূপ আইনি ঝামেলা কাউকে যেন জড়ানো না হয়। সবাই বাঁচুক। শুধু শুধু পৃথিবীর অক্সিজেন আর নষ্ট করতে চাই না। ফিরোজ ; রাত:১১টা ৫’।
তবে লেখাটি ফিরোজের কিনা তা জানা যায়নি। তবে তার বন্ধুরা জানিয়েছেন, এটা ফিরোজের হাতের লেখার মতোই তাদের মনে হচ্ছে। তবে ফিরোজের মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে আসা তার বড় ভাই জানিয়েছেন, তার এবং ফিরোজের লেখা প্রায় একই। খাতায় থাকা এই লেখাটা ফিরোজের হাতের লেখা নয়। এরপর তারা ফিরোজের মরদেহের সুরতহাল করার সিদ্ধান্ত নেন।
ফিরোজের রুমমেট ও বন্ধুরা যা জানালেন
মাসুদ। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র। কাজী ফিরোজের এই রুমমেট জানিয়েছেন, আমি রাত ১২টার সময় ওর বেডেই শুয়ে ছিলাম। সেও রুমে ছিল তখন। এদিক সেদিক পায়চারী করছিল। সে আমাকে বলে, ‘বন্ধু, তোর মোবাইলটা একটু দে। আমি একটা জায়গায় ফোন দেবো।’ এরপর সে আমার মোবাইল নিয়ে কোনো একটা নম্বরে ফোন দেয়। একটু পরে আমাকে ফোন ফেরত দিয়ে দেয়। পরে আমি সোয়া ১২টার দিকে রুম থেকে বের হয়ে চলে আসি।
কাজী ফিরোজের আরেক বন্ধু আবদুল্লাহ বলেন, ‘কবি জসীমউদ্দীন হল মাঠে আনুমানিক রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার দিকে তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। অনেক দিন পর দেখা হওয়ায় তার সাথে কুশল বিনিময় করলাম। পরে সে আমার মোবাইল নিয়ে কাকে যেন ফোন দিয়েছিল। তখন তাকে ডিপ্রেসড মনে হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পর সে আমার মোবাইল ফেরত দিয়ে দেয়। পরে আমি চলে আসি।’
ফিরোজের এক রুমমেট বলেন, রাত ১০টার পরে সে রুমে আসে। তার জন্য টেবিলে খাবার রাখা ছিল। আমি তাকে বলি, খাবার তো নষ্ট হয়ে যাবে। খাবার খেয়ে নে। সে বলে, খামু। এরপর সে অজু করে এসে নামাজ পড়েছে। নামাজ শেষে সে তার টেবিলে বসল। আমরা ভেবেছি, সে হয়তো পড়তে বসেছে। এরপর আমরা রুমের লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়ি। এরপর সে বের হয়ে যায়। এ সময় তার বেডমেট জিজ্ঞেস করল, কই যাস? তখন সে বলে, আসতেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘অল্প সময় পর আমরা খবর পাই, বিজয় একাত্তর হল থেকে কেউ একজন নিচে লাফ দিছে। এটা শোনার সাথে সাথে আমি লাফ দিয়ে উঠি। যেহেতু ফিরোজ শেষ কিছুদিন ধরে একটু ডিপ্রেসড ছিল, তাই আমি সবাইকে বলি, ফিরোজ কই? দেখি রুমে ফিরোজ নেই। এরপর আমরা সবাই দৌড় দিয়ে বিজয় একাত্তরের সামনে আসি। ততক্ষণে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আমরা হাসপাতালে এসে দেখি ফিরোজই।’
ফিরোজের বেডমেট মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘আমি লাইব্রেরি থেকে যখন রুমে আসি, এর কিছুক্ষণ পর ফিরোজ রুমে আসে। সাড়ে ১০টার দিকে সে সবাইকে বলছে, তোরা কেউ আমার কাছ থেকে কোনো টাকা পাস কি না বল। এমনকি ২ টাকা হলেও বল। আমি দিয়ে দিতে চাই। পেলে এখনই বল। কিছুক্ষণ পর সে মানিব্যাগ এবং মোবাইল রেখে রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। তখন আমি বলি, কই যাচ্ছিস? সে বলে, আমি একাত্তর হলে যাচ্ছি, একটু কাজে। এরপর আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি।’
মাসুম বলেন, তার জন্য রাখা খাবারটা সে অল্প একটু খেয়েছে। বেশির ভাগ খাবারই সে রেখে দিয়েছিল।
রমনা জোনের এডিসি শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম বলেন, আমরা সংবাদ পেয়েছি জিয়া হলের এই শিক্ষার্থী ছাদ থেকে পড়ে গেছেন। এরপর তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আমরা এই শিক্ষার্থীর মরদেহ সুরতহাল করে মৃত্যুর প্রাথমিক কারণ নির্ণয় করার চেষ্টা করছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিজয় একাত্তর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছির বলেন, রোগীর বিষয়ে ডাক্তার নেগেটিভ বার্তা দিয়েছে। এখন মেডিকেল ছাড়পত্রের জন্য অপেক্ষায় আছি। ছেলের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা ঢাকার পথে রওনা দিয়েছেন।