সালটা ছিল ১৯৯০। তখন হারেজ খান ছিলেন ২৫ বছরের যুবক। কিছুটা মানসিক সমস্যা ছিল তার। ওই সময় তার নিজ এলাকায় আবির্ভাব ঘটে এক ভিক্ষুকের। তার সঙ্গে পরিচয় হয় হারেজ খানের। সেই ভিক্ষুকের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে বেড়াতেন। একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান, আর ফেরে্ননি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাকে পায়নি তার পরিবার।
তবে গত শনিবার (১৬ সেপ্টম্বর) টানা ৩৩ বছর পর চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার হোগলডাঙ্গা গ্রামে হারেজ খানের সন্ধান পেয়েছে পরিবারের সদস্যরা।
হারেজ খান (৫৮) মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের সাইংজুরি গ্রামের মৃত চেনু খাঁর ছেলে।
জানা যায়, ১৯৯০ সালে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার নাটুদাহ ইউনিয়নের হোগলডাঙ্গা গ্রামের একটি গাছের নিচে মানসিক অসুস্থ হারেজ খানকে বসে থাকতে দেখেন হোগলডাঙ্গা গ্রামের সোনাহার মণ্ডল। নাম পরিচয় বলতে না পারায় তাকে বাড়ি নিয়ে যান সোনাহার মণ্ডল। সেই থেকেই নিজের ৫ ছেলে-মেয়ের মতো করেই লালন পালন করেছেন তাকে। হারেজের সখ্যতা তৈরি হয় ওই গ্রামের মানুষের সঙ্গে। গ্রামে ঘুরে ঘুরে গান গাইতেন তিনি। সবাই তাকে ভালবাসে।
সোনাহার মণ্ডল ছলছল চোখে বলেন, ১৯৯০ সালে তাকে আমাদের গ্রামের বটতলায় পাই। ওই সময় তাকে বাড়ি নিয়ে আসি। তখন সে মানসিক অসুস্থ ছিল। আদর যত্নে আমার ৫ ছেলে-মেয়ের মতো করেই তাকে আমি মানুষ করেছি। তাকে কখনো বাবা-মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। সম্প্রতি হারেজ খান তার গ্রামের নাম বলতে পারায় সেই ঠিকানা অনুযায়ী আমার ছেলে মতিয়ার রহমান স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিস্তারিত জানিয়ে তার পরিবারের সন্ধান পাই। এরপর মোবাইল ফোনে ছবি ও ভিডিও কলে কথা বলে তারা হারেজকে শনাক্ত করেন।
তিনি আরও বলেন, গত শনিবার মানিকগঞ্জ থেকে হারেজ খানের বোনসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি আসেন আমার বাড়িতে। তাকে বিদায় দিতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল, আমার আপন ছেলে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
এদিকে গত শনিবার দুপুরে হোগলডাঙ্গা গ্রামে আসেন হারেজের পরিবার। দীর্ঘদিন পর ভাইকে দেখে কাঁন্নায় ভেঙে পড়েন তার একমাত্র বোন নূর জাহান। তৈরি হয় এক হৃদয় বিদারক পরিবেশের। অশ্রুসিক্ত হয় গ্রামের মানুষের চোখ। যেন কোনো এক আপনজনকে বিদায় দিচ্ছেন তারা।
হারেজ খানের বোন নূর জাহান খাতুন জানান, আমাদের বাবা মারা গেছেন। মা বেঁচে আছেন। ভাই হারিয়ে যাওয়ার পর তাকে অনেক খুঁজেও পাইনি। ৩৩ বছর পর একমাত্র ভাইকে খুঁজে পেয়ে অনেক আনন্দ লাগছে। তার সঙ্গে আবার দেখা হবে ভাবতেও পারিনি। মাকে জানিয়েছি, তিনি তার ছেলের অপেক্ষায় আছেন।
হোগলডাঙ্গা গ্রামবাসীরা জানান, অনেক ছোটবেলা থেকে হারেজ খানকে দেখছেন তারা। ভারসাম্যহীনভাবে পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। সবাই তাকে পাগল বলেই চেনে। ছোট থেকেই গ্রামে গান গাইতো। গানের মাধ্যমে তিনি তার এলাকার নাম, পরিবারের সদস্যদের নাম বলতেন। তখন কেউ বুঝত না। গ্রামের নাম-ঠিকানা বললে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা তাকে নিয়ে গেছেন।
মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান কাজী মাহেলা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমিসহ হারেজের পরিবারের সদস্যরা চুয়াডাঙ্গায় গিয়েছিলাম। টানা ৩৩ বছর পর হারেজকে বাড়িতে নিয়ে এসেছি। তার একটি পায়ে বিশেষ চিহ্ন দেখে সহজেই শনাক্ত করে পরিবার। ছোট থেকেই মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ছিলেন তিনি। ৩৩ বছর আগে বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি।
নিজের সন্তানের মতোই এতদিন লালন পালন করেছেন সোনাহার দম্পতি। এখনকার যুগে কেউ কাউকে দেখে না। তবে এই দম্পতি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।