রাজধানী ঢাকার প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে অনেকটা ব্যক্তিগত গাড়িবান্ধব উড়াল সড়কে পরিণত হয়েছে। যেখানে ছোট গাড়ি উঠছে বেশি, বাস ও ট্রাকের মতো বড় গাড়ি কম উঠছে।
যানচলাচল শুরুর পর ১৪ দিনে সবমিলিয়ে যত গাড়ি চলাচল করেছে তার গড় হিসাব করে দেখা গেছে প্রতি ঘণ্টায় এই দ্বিতল সড়ক ব্যবহার করেছে ১২০৬টি গাড়ি। যানবাহনের প্রকার বা ধরন অনুযায়ী এক্সপ্রেসওয়েতে সবচেয়ে বেশি উঠেছে প্রাইভেট কার বা ব্যক্তিগত গাড়ি। তাই আপাতত সড়কটিকে ‘ব্যক্তিগত গাড়িবান্ধব এক্সপ্রেসওয়ে’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা।
বিমানবন্দর র্যাম্প-সংলগ্ন এলাকায় কয়েকজন ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন, সকালের দিকে কয়েকটি বাস এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠে। এসব বাসের বেশিরভাগই সরকারি; বিআরটিসি বাস বা অফিস বাস। কোনো লোকাল বাসকে এখানে উঠতে দেখিনি। তবে দূরপাল্লার ২/১টি বাস মাঝে মধ্যে উঠতে দেখা গেছে।
রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) সকালে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম এস আখতার ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন, ৩ সেপ্টেম্বর ভোর ৬টা থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর ভোর ৬টা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ৪ লাখ ৫ হাজার ৫৯টি গাড়ি চলাচল করেছে।
তিনি জানান, এখন পর্যন্ত ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকার টোল আদায় হয়েছে। এক্সপ্রেসওয়েতে ক্যাটাগরি-১ এর যানবাহন উঠেছে ৪ লাখ ২ হাজার ২৮৬টি। ক্যাটাগরি-২ এর যানবাহন উঠেছে ৮১৯টি, ক্যাটাগরি-৩ এর যানবাহন উঠেছে ৩৭টি এবং ক্যাটাগরি-৪ এর যানবাহন উঠেছে এক হাজার ৯১৭টি। গতকাল (১৬ সেপ্টেম্বর) এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি উঠেছে ২৮ হাজার ৭৭৪টি।
যান চলাচলের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানান তিনি। এখন পর্যন্ত গাড়ির সংখ্যাও আশানুরূপ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ক্যাটাগরি-১ এর যানবাহনগুলো হচ্ছে— কার, ট্যাক্সি, জিপ, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল, মাইক্রোবাস (১৬ সিটের কম) ও হালকা ট্রাক (৩ টনের কম); ক্যাটাগরি-২ এর যানবাহন হচ্ছে— মাঝারি ট্রাক (৬ চাকা পর্যন্ত); ক্যাটাগরি-৩ এ রয়েছে ট্রাক (৬ চাকার বেশি) এবং ক্যাটাগরি-৪ এ রয়েছে সব ধরনের বাস (১৬ সিট বা এর বেশি)।
হিসাবে দেখা যায়, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে ছোট যানবাহনগুলো; এর মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাই বেশি। অন্যদিকে সবচেয়ে কম ব্যবহার করেছে ৬ চাকার বেশি লরি বা কার্ভাড ভ্যানগুলো। ব্যবহারের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাস। তবে, সে সংখ্যা ২ হাজারের বেশি নয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বর্তমানে যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করলাম, সেটি একটি ব্যক্তিগত গাড়িবান্ধব এক্সপ্রেসওয়ে। পৃথিবীর কিছু কিছু দেশে যেমন- চায়না, কোরিয়া, সাও পাওলো, এছাড়া দক্ষিণ আমেরিকার কিছু শহর আছে, যেখানে গণপরিবহনবান্ধব কিছু ফ্লাইওভার তৈরি করেছে। সেটা গণপরিবহনকে প্রাধান্য দিয়েই তৈরি করা হয়। যেহেতু দ্রুতগতির একটি ফ্লাইওভার আমরা তৈরি করেছি, যেখানে যাত্রী উঠানামার কোন ব্যবস্থা নেই। তাই, আমি বলব- এটি ব্যক্তিগত গাড়িবান্ধব একটা অবকাঠামো। সঙ্গত কারণেই সিটি বাসগুলো এখানে উঠবে না।
তিনি আরও বলেন, এক কথায় বলতে গেলে আমরা বিমানবন্দর সড়কের জন্য দ্রুতগতির ব্যক্তিগত গাড়িবান্ধব একটা অবকাঠামো (এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) তৈরি করলাম। এটি যখন কুতুবখালী পর্যন্ত পুরোপুরি তৈরি হবে, তখনও সিটির জন্য কোনো উপযোগিতা তৈরি করবে না। এই এক্সপ্রেসওয়ে বলেই দিচ্ছে যে আমরা এখানে বাস সার্ভিস চালাতে পারি, তবে সেটা এক্সপ্রেস বাস সার্ভিস হতে হবে। তাই আমি বলব, এই এক্সপ্রেসওয়েটি সিটির ভেতর যে সড়কগুলো আছে, তার মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ির একটি বিকল্প সড়ক হিসেবে কাজ করবে।
গত ২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে এর উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এর পরদিন ৩ সেপ্টেম্বর ভোর ৬টা থেকে এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিক ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের দক্ষিণ কাওলা থেকে শুরু হয়ে কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-মালিবাগ-খিলগাঁও-কমলাপুর হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত যাবে। এই এক্সপ্রেসওয়ের মূল দৈর্ঘ্য ১৯.৭৩ কিলোমিটার, র্যাম্পসহ দৈর্ঘ্য ৪৬.৭৩ কিলোমিটার।
প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা; যার মধ্যে ২৭ শতাংশ বাংলাদেশ সরকার ভিজিএফ হিসেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে দেবে। এ পর্যন্ত প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে এবং ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকল্পের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের সংশোধিত চুক্তি সই হয়। প্রকল্পটি থাইল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইতালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড ৫১ শতাংশ, চীনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপের ৩৪ শতাংশ ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড ১৫ শতাংশ অংশীদারিত্বে নির্মাণ হচ্ছে।
বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে ফার্মগেট অংশ পর্যন্ত যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। র্যাম্পসহ এই অংশের দৈর্ঘ্য সাড়ে ২২ কিলোমিটার। ডিজাইন স্পিড বেশি থাকলেও বর্তমানে এই অংশে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলছে।