যশোরের শার্শা উপজেলার শ্যামলাগাছি গ্রামে অবস্থিত হযরত শাহজালাল ফ্রি মডেল মাদরাসা। যে মাদরাসায় ছাত্রদের পড়াতে কোনো অর্থ নেওয়া হয় না। গত দুই বছর ধরে এ মাদরাসা পরিচালনা করে আসছেন উদ্ভাবক মিজানুর রহমান।
মিজানুর রহমান শুধু এই ফ্রি মডেল মাদরাসা চালু করেনি, তিনি তার মাদরাসা প্রাঙ্গণে অসহায়, পথচারী ও ভিক্ষুকদের জন্য ‘ফ্রি খাবার বাড়ি’ চালু করেছেন। তবে এ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান চালাতে বর্তমানে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। ফলে অর্থায়নের সংকটে বন্ধ হওয়ার শঙ্কায় ভুগছেন দেশের বহুল আলোচিত এ দুই সেবামূলক প্রতিষ্ঠান।
মিজানুর রহমান জানান, তিনি গত চার বছর আগে ‘ক্ষুধা লাগলে খেয়ে যান’ এমন স্লোগানে অসহায়, পথচারী, ভিক্ষুকদের জন্য ‘ফ্রি খাবার বাড়ি’ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে ছিন্নমূল মানুষের মাঝে খাদ্যসহ বিভিন্ন ওষুধ ও প্রয়োজনীয় উপাদান সামগ্রী সহায়তা করা শুরু করেন তিনি। দেশ ও প্রবাস থেকে আর্থিক অনুদান দিয়েও টেনেটুনে চলছিল তার বহুমুখী সামজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটি। খরচ সামলে উঠতে না পেরে বছর দুয়েক আগে তার শেষ সম্বল শার্শা উপজেলার জাতিপাড়া ও শ্যামলাগাছিতে দুটি বাড়ি প্রায় ১৮ লাখ টাকায় বিক্রয় করেন। বাড়ি বিক্রির টাকাটিও তিনি তার ফ্রি মাদরাসা ও ফ্রি খাবার বাড়িতে ব্যয় করেছেন। তবে সম্প্রতি সময়ে তার মাদরাসার ছাত্রের সংখ্যা এবং ফ্রি খাবার বাড়িতে খেতে আসা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় খরচ সামলে উঠতে পারছেন না।
মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার মাদরাসায় বর্তমানে ৩০ জন ছাত্র রয়েছে, তিন বছরেরও এতিম বাচ্চা আমার কাছে রয়েছে। মাদরাসার জনবল রয়েছে ১০ জনের মতো। অপরদিকে অসহায় ক্ষুধার্থদের জন্য প্রতিষ্ঠা করা ‘ফ্রি খাবার বাড়িতে’ প্রতিদিন প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ জন পথচারী, ভিক্ষুক, মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষেরা তিনবেলা খেয়ে থাকে। সব মিলিয়ে মাসে আমার এ দুই সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে ব্যয় হয় প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এ সব টাকার উৎস হচ্ছে অনেকের অনুদান, যে যেমন পারে দেয়। সবথেকে বড় অংকের টাকাটি আমার কাছ থেকেই দিয়ে থাকি। এর পিছনে আমি আমার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে দিয়েছি। মানুষের সেবা করতে গিয়ে কখনো নিজের পরিবারের কথা ভাবিনি। দুটি বাড়ি বিক্রি করে, বিক্রিত অর্থ আমার মাদরাসা ও ফ্রি খাবার বাড়িতে ব্যয় করেছি।’
তিনি বলেন, আমার এ সেবা কার্যক্রম শুধু এ গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আমি এর বাহিরে পথে পড়ে থাকা পাগল অসহায়দের শীতের পোশাক, খাবার, ওষুধ ইত্যাদি দেই। অস্বচ্ছল পরিবারের পাশে দাঁড়াই। আমার সেবা কার্যক্রম বৃহৎ পরিসরে বৃদ্ধি করার পেছনে সবথেকে বড় অবদান গণমাধ্যমকর্মীদের। তারা আমার ভালো কাজগুলোকে মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। তবে বর্তমান সময়ে আমি এ প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। দ্রব্য মূল্য বেড়ে যাওয়ায় মানুষ দান কমিয়ে দিয়েছে। অনেকে আবার করেই না। নিজের যা কিছু সম্পদ ছিল তাও বিক্রি করা হয়ে গেছে। এখন এ প্রতিষ্ঠান অর্থের অভাবে বন্ধ হবার শঙ্কায় ভুগছে।’
শার্শা সদর ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য আতিয়ার রহমান বলেন, মিজান দেশের মধ্যে একজন নামকরা সমাজসেবী। সে যেভাবে মানুষের সেবার নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে এমনটা কোনো বিত্তবানও করে না। করে শুধু সমালোচনা। তাতেও আটকেনি মিজানের এ সেবামূলক কাজ। তবে বর্তমানে সহোযোগিতার অভাবে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হতে বসেছে। এ প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হলে অনেক এতিম বাচ্চাকে আবারও পথের ঠিকানায় ফিরে যেতে হবে, আহার বন্ধ হয়ে যাবে শত শত ভিক্ষুক এবং অসহায়দের। এজন্য আমরা তার হয়ে সহোযোগিতা কামনা করছি।
প্রতিবেশী জসিম উদ্দিন বলেন, মিজান ভাই যখন সমাজসেবা শুরু করেন তখন আমরা তাকে অনেক সহোযোগিতা করেছি। হয়তো অর্থ দিয়ে না করলেও পরামর্শ, শ্রম দিয়ে তাকে সহোযোগিতা করেছি। আমরা চাই মিজান ভাইয়ের এ প্রতিষ্ঠান শত শত বছর টিকে থাকুক। এজন্য শুধু মিজান ভাই হলে হবে না এখানে সম্মিলিত সহোযোগিতারও প্রয়োজন আছে।
উদ্ভাবক মিজানুর রহমান শার্শা উপজেলার শ্যামলাগাছি গ্রামের বাসিন্দা। তিনি পেশায় একজন মোটর মেকানিক। শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও গত দশ বছরে তিনি উদ্ভাবন করেছেন বিভিন্ন দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি গাড়ি, যন্ত্রপাতিসহ অনেক কিছু। পেয়েছেন জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি। তবে উদ্ভাবনেই তার কাজ শেষ হয়নি। চার বছরেরও অধিক সময় ধরে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন সমাজসেবায়। পথের কুকুর থেকে শুরু করে পথচারী, ভিক্ষুক, মানসিক প্রতিবন্ধীদের দৈনন্দিন খাদ্য সহায়তাও করে থাকেন তিনি।