কুষ্টিয়ার দৌলতপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। ঘুষ, অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে সরকারি এই কার্যালয়টি। দালাল চক্রের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন সেবা প্রত্যাশীরা।
দলিল লেখক সমিতির লোকজন, স্ট্যাম্প ভেন্ডারের মালিকরা ও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত একটি চক্র রমরমা ঘুষ বাণিজ্য করে আসছে। ঘুষের টাকার ভাগ সাব-রেজিস্ট্রার আনোয়ার হোসেনের পকেটে যায় বলে জানা গেছে।
সিন্ডিকেটের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে দলিল রেজিস্ট্রি করে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। সাব-রেজিস্ট্রার ও দালাল চক্রের মাধ্যমে বাধ্যতামূলকভাবে প্রতি দলিল রেজিস্ট্রি করার জন্য অতিরিক্ত ২৫০০ টাকা আদায় করা হয়। নামের ভুল থাকলে ঘুষ দিতে হয়। পরিচয়পত্র অনলাইন থেকে প্রিন্ট করাতে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা দিতে হয়। দলিলের দাম বেশি নেওয়া হয়। এভাবে প্রতিটি সেবার জন্য পদে পদে ঘুষ দিতে হয়।
ভুক্তভোগী ইব্রাহীম বলেন, দৌলতপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে দুর্নীতি অনিয়মের শেষ নেই। আইডি কার্ডে নামের ভুল থাকলে ঘুষ লাগে। জমি রেজিস্ট্রি করতে, দলিল করতে ঘুষ দেওয়া লাগে। ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। প্রতি দলিলের জন্য ২৫০০ টাকা বাড়তি টাকা আদায় করা হয়। দলিল লেখক সমিতির মহুরিরা জোরপূর্বক ঘুষ আদায় করে। সাব-রেজিস্ট্রার অফিস ভবনের ইটও টাকা চায়। ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না। আমরা গ্রামের মানুষ। এতকিছু বুঝি না। ভোগান্তি পোহানোর ভয়ে ঘুষ দিয়ে কাজ করি।
দৌলতপুর সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, জমির ক্রেতা-বিক্রেতা, দলিল লেখক আর দালালের প্রচণ্ড ভিড়। দালাল চক্রটি তাদের মন মতো কমিশনের ভিত্তিতে জমি নিবন্ধনের কাজ করিয়ে দেন। দালাল ছাড়া গেলে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। প্রতিটি দলিল রেজিস্ট্রি করতে ২৫০০ ঘুষ আদায় করা হয়। প্রতিটি পদে পদে ঘুষ আদায় করা হয়। সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে দালাল চক্রের লোকজন সাংবাদিকদের প্রাণনাশের হুমকি দেন, হামলার চেষ্টা করেন এবং অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন।
ভুক্তভোগী আব্দুল বারি বলেন, আমি দুটি জমি রেজিস্ট্রি করার জন্য ২৫০০ টাকা করে মোট ৫ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছি। ঘুষ না দিলে কাজ হয় না। জাতীয় পরিচয়পত্র মূল কপি না থাকায় অনলাইন থেকে কপি প্রিন্ট করার জন্য ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা হাতিয়ে নেয় দালাল চক্র। ঘুষের টাকা দলিল লেখক সমিতির লোকজন, সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় মস্তান বাহিনী ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। সমিতির মাধ্যমে ঘুষ আদায় করা হয়। ঘুষ ছাড়া জমি রেজিস্ট্রি করেন না সাব-রেজিস্ট্রার। এখানে ঘুষ বাণিজ্য প্রথায় কাজ চলে।
দৌলতপুর উপজেলার বেশ কয়েকজন সার্ভেয়ার ও মুহুরি বলেন, বর্তমানে দৌলতপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের চেয়ার-টেবিলও ঘুষ চায়। ঘুষ ছাড়া দলিল হয় না, কোনো কাজ হয় না। দীর্ঘদিন ধরেই রমরমা ঘুষ বাণিজ্য করে আসছে একটা চক্র। এজন্য যারা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে কাজে যান, তারা ঘুষের টাকা নিয়ে যায়। প্রত্যেকটি কাজের জন্যই ঘুষ দিতে হয়। প্রতিটি দলিলের জন্য বাড়তি টাকা দিতে হয়। ঘুষ ছাড়া কেউ জমি রেজিস্ট্রি করাতে পারে না। সাব-রেজিস্ট্রার, তার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, দলিল লেখক সমিতির নেতারা, স্থানীয় দালাল, রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির মানুষ এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত, সবার পকেটে ঘুষের টাকার ভাগ চলে যায়।
তারা আরও বলেন, দালাল চক্র নিয়ন্ত্রণ করে নুরুজ্জামান, দলিল লেখক সমিতির সভাপতি বেল্লাল হোসেন, নকল নবিশ আইনাল হোসেন, স্থানীয় ক্যাডার মিজানুর রহমান, সাব-রেজিস্ট্রার অফিস সহকারী মুন্নী। প্রভাবশালী এই চক্রের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারেন না, প্রতিবাদ করতে পারেন না। ঘুষ না দিলেই তার সমস্যা, কাজ তো হবেই না, ভোগান্তি পোহাতে পোহাতে জীবন কাহিল হয়ে যাবে। টাকা ছাড়া সাব-রেজিস্ট্রার কাজ করে না।
বৃদ্ধ এক ভুক্তভোগী বলেন, আমি ও আমার ছেলে বাড়ি থেকে আসল এনআইডি কার্ড আনিনি। এজন্য অনলাইন থেকে প্রিন্ট করতে এক হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার ভাই ছয় কাঠা জমি কিনেছে। এ জমি রেজিস্ট্রির জন্য দৌলতপুর সাব রেজিস্টার অফিসের দলিল লেখক ও দালাল চক্রকে ১৮ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। মহুরি জোরপূর্বক অন্যান্যভাবে এতো টাকা নিয়েছেন। তারা বলেছে- দলিল লেখক সমিতি, অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিভিন্ন জায়গায় টাকা দিতে হবে, তা-না হলে কাজ হবে না। এজন্য বাড়তি টাকা দিতে বাধ্য হয়েছি। এরপর একটা টিপ দিতে ২০০ টাকা চেয়েছে। আমার কাছে টাকা না থাকায় রাগ করে চলে যাচ্ছি।
দুর্নীতির কথা অস্বীকার করে দলিল লেখক সমিতির সভাপতি বেল্লাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে দৌলতপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে কোনো দুর্নীতি নাই। দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা।
সাব-রেজিস্ট্রার আনোয়ার হোসেন বলেন, দলিল লেখকরা আমাকে দিনে তিনবার বিক্রি করে। আমি ও আমার অফিসের কেউ দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত না। ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম এখনো চালু হয়নি। দ্রুতই চালু হবে বলে আশা রাখি। অফিসের বাইরের কেউ বা দালাল চক্র যদি দুর্নীতি অনিয়ম করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
দেশে ভূমি হস্তান্তর দলিল নিবন্ধন হচ্ছে ১৯০৮ সালের রেজিস্ট্রেশন আইনে। এ আইন অনুযায়ী ভূমি নিবন্ধনের দায়িত্ব সাব-রেজিস্ট্রারের। সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়গুলো দেখভাল করে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা নিবন্ধন অধিদপ্তর। তবে দৌলতপুর সহ কুষ্টিয়া জেলার সব সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে খোঁজ নিয়েও একই চিত্র পাওয়া গেছে। অনেক সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে জাল দলিল তৈরির চক্রও সক্রিয়। ঘুষ ছাড়া জমি রেজিস্ট্রি করেন না সাব-রেজিস্ট্রাররা।
নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিবন্ধন উম্মে কুলসুম বলেন বিষয়টি জানতাম না। আমি খোঁজ খবর নিয়ে দেখব। নিয়মের বাইরে যদি অনিয়ম দুর্নীতি হয় তাহলে অবশ্যই আইনি পদক্ষেপ নেব। যারা দুর্নীতি করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কেউ ছাড় পাবে না।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কুষ্টিয়া-১ আসনের (দৌলতপুর) সংসদ সদস্য আ ক ম সরওয়ার জাহান বাদশাহ ও কুষ্টিয়া জেলা রেজিস্ট্রার সৈয়দা রওশন আরা’র মোবাইল ফোনে কল করলেও তারা রিসিভ করেননি।