হাজার হাজার কোটি টাকা তো ব্যাগে করে নিয়ে যায়নি

অর্থপাচার নিয়ে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

দেশের ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা চলে গেছে। এগুলো তো ব্যাগে করে নিয়ে যায়নি। একটি মাধ্যমে গেছে। কোথায় গেছে তারও রেকর্ড আছে সংস্থাগুলোর কাছে। চাইলেই এটি বের করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।

শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। সভায় ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম উপস্থিত ছিলেন।

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, দেশের ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা চলে গেছে। এগুলো তো ব্যাগে করে নিয়ে যায়নি। কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে নিয়ে গেছে। কোনো অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে। বেনামে গেলেও অ্যাকাউন্টের তথ্য ব্যাংকগুলোর কাছে আছে। ১০ লাখ টাকার ওপরে লেনদেন হলে রেকর্ড থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে। তারা চাইলেই টাকা কোথায় গেছে এটা জানা সম্ভব। কারণ ব্যাংকিং সিস্টেমে সব তথ্যই রেকর্ড থাকে। টাকা কোথায় গেছে, কার কাছে সবই জানা যায়।

হলমার্কের কেলেঙ্কারি সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের সমালোচনা করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, হলমার্কের কেলেঙ্কারি হয়েছে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় জেলগেটে গিয়ে। এটা তো অনেক পুরোনো একটি সিস্টেম। সে কোথায় টাকা নিয়ে গেছে এটা জেলগেটে গিয়ে কেন জিজ্ঞাসা করতে হবে। তাহলে ডিজিটাল সিস্টেম করে লাভ কী? ব্যাংক চাইলে তার লেনদেনের সব তথ্যই বের করতে পারবে– সে কোন কোন জায়গায় টাকা পাঠিয়েছে।

তিনি বলেন, কানাডার বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থপাচারের তথ্য আমরা শুনি। যেখানে আমরা শুনি-জানি সেখানে ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলো অবশ্যই জানে কিন্তু বলে না।

অর্থপাচার অর্থনীতির জন্য ক্ষতি জানিয়ে অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, যেকোনোভাবে অর্থপাচার হোক না কেন তা দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতি অর্থাৎ অর্থপাচার হলে ক্ষতি হবে।

তিনি বলেন, আগে শুধু আমদানি-রপ্তানিতে দাম কমবেশি দেখিয়ে অর্থপাচার হতো। এখন অর্থপাচারের অনেকগুলো মাধ্যম সৃষ্টি হয়েছে। যে যেভাবে সুযোগ-সুবিধা পায় সে সেভাবেই পাচার করে। অর্থপাচার বাড়লে রেমিট্যান্স কমে যাবে।

দুর্নীতি অর্থপাচারের বড় কারণ জানিয়ে ড. ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, যারা দুর্নীতি করে অর্থ উপার্জন করছে তারা যদি মনে করে দেশে এ অর্থ রাখা নিরাপদ নয়, তারা যেকোনো কৌশলে অর্থপাচার করবে। এখন অনেকে দ্বৈত নাগরিক হওয়ার জন্য বিদেশে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, অর্থপাচারের আরেকটি সহজ মাধ্যম অফশোর ব্যাংকিং। এখন অনেক ব্যাংক বিদেশে অফশোর ব্যাংকিং চালু করেছে, যার মাধ্যমে চাইলে অর্থপাচার করা যায়। কারণ অফশোর ব্যাংকিংয়ের শাখায় কত অর্থ সংগ্রহ করছে তার কোনো হিসাব নেই। নিজেদের মতো অর্থ সংগ্রহ করে ইচ্ছে মতো রেখে দিচ্ছে। আর ব্যাংকের মালিকরা চাইলে তার কোনো হিসাবই থাকে না।

প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স বাড়ানো সম্ভব নয় জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আশানুরূপ রেমিট্যান্স আসছে না। আর আসবেও না। রেট বাড়িয়ে রেমিট্যান্স আনা যাবে না। কারণ বিদেশে অর্থের চাহিদা যদি না কমে তাহলে কোনোভাবেই পাচার রোধ করা যাবে না। যাদের অর্থ নেওয়ার প্রয়োজন হবে তারা যেকোনো উপায়ে অর্থপাচার করে নিয়ে যাবেই।

অর্থনীতি অনেক ভালো ছিল বলেই এখন বেশি খারাপ মন্তব্য করে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছিল। আমরা যত ইচ্ছা প্রকল্প নিচ্ছিলাম। আমাদের তো যথেষ্ট রিজার্ভ আছে, কোনো অসুবিধা নেই। ভবিষ্যতে যে হঠাৎ করে কোনো চাপ আসতে পারে, সেটা চিন্তায় ছিল না। যার কারণে আমরা সময় মতো সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারিনি। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে প্রতি বছর কিন্তু দীর্ঘদিন ডলার রেট ধরে রেখেছে, বাড়তে দেয়নি। যার কারণে এখন বেশি সমস্যায় পড়েছে। কারণ হঠাৎ করে দাম বেড়ে যাওয়ায় চাপে পড়েছে অর্থনীতি। আগে থেকে যদি আস্তে আস্তে দাম বাড়ত তাহলে এখন দাম বেড়ে এমন সমস্যায় পড়তে হতো না।

তিনি বলেন, রিজার্ভ অনেকে আছে বলে আমরা একের পর এক বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প করছি। এগুলো ঋণের মাধ্যমে করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকগুলো আছে প্রয়োজনীয়। অনেকগুলো আবার এসময়ে প্রয়োজন ছিল না।

এই অর্থনীতিবিদ জানান, আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে বিদেশি ঋণ ফেরত দিতে হবে, বছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। যদি ভবিষ্যতে আরও ঋণ নিই তাহলে পরিশোধের পরিমাণ আরও বাড়বে। এজন্য লাভ-ক্ষতি বিবেচনা করে আমাদের বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প নিতে হবে বলে জানান বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ।

Related Posts

Next Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Welcome Back!

Login to your account below

Create New Account!

Fill the forms below to register

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.