সাধারণ ছুটি, লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধ সব সময়ই জরুরি সেবা হিসেবে চলছে ব্যাংকিং কার্যক্রম। স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও জীবনবাজি রেখে গ্রাহকদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন ব্যাংকাররা। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে অনেক ব্যাংককর্মী। এমন দুর্যোগের সময় ব্যাংকারদের পাশে না থেকে উল্টো বেতন কমিয়েছে বেসরকারি সিটি ও এক্সিম ব্যাংক। কর্মীদের ক্ষোভ, বিভিন্ন মহলের সমালোচনার পরেও তা পুরোপুরি সমন্বয় করেনি এই দুটি ব্যাংক।
জানা গেছে, ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে যখন মহামারির প্রাদুর্ভাবে টালমাটাল অবস্থা। ঠিক তখনই মালিকদের পরামর্শে কয়েকটি ব্যাংক বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের মধ্যে এক্সিম ব্যাংক, এবি, ওয়ান, দ্য সিটি ও আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক অন্যতম। এবি, ওয়ান ও আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক কর্মীদের বেতন কমানো বিষয়টি সমাধান করলেও এখনো কম বেতন দিয়ে আসছে সিটি ও এক্সিম ব্যাংক।
এদিকে ব্যাংক দুটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা আয় করছে। মহামারির বছরেও ব্যাংকের আয় হয়েছে তারপরও বেতন কম দিচ্ছে। শুধুমাত্র পর্ষদের স্বেচ্ছাচারিতায় এ অবিচার করা হচ্ছে। ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে ব্যাংকাররা অথচ তাদের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে রেখেছে। ৫৮ ব্যাংক তাদের কর্মীদের বেতন বোনাস দিয়ে যাচ্ছে। তাহলে এ দুই ব্যাংকের সমস্যা কোথায় বলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান অনেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিটি ব্যাংক লিমিটেড তার কর্মীদের ১৬ শতাংশ বেতনভাতা কমিয়ে দেয় মহামারির ওই সময়। এই ১৬ শতাংশের মধ্যে ১০ শতাংশ বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ৬ শতাংশ। গত বছরের ১ জুন থেকেই কার্যকর হওয়া এই সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে চলতি বছরের অর্থাৎ ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এছাড়া ব্যাংকটি ২০২১ সালের পারফরম্যান্স বোনাস ও ইনক্রিমেন্টও দেবে না বলে জানায়।
সিটি ব্যাংকের ২০২০ সালের চতুর্থ প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, মহামারির বছরে ব্যাংকটির শেয়ার প্রতি ব্যাংকটির আয় বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। ২০২০ সালে সিটি ব্যাংকের সমন্বিত শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) দাঁড়িয়েছে ৪ টাকা ২৯ পয়সা, যা ২০১৯ সালে ছিল ২ টাকা ৫৯ পয়সা। এছাড়া ২০২০ সালে ব্যাংকটির কর পরবর্তী সমন্বিত মুনাফা (প্রফিট আফটার ট্যাক্স) দাঁড়িয়েছে ৪৩৬ কোটি টাকা। যা তার আগের বছর ছিল ২৬৩ কোটি টাকা। তারপরও কর্মীদের বেতন কম দিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকটি।
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশরুর আরেফিন বলেন, মাত্র ইনক্রিমেন্ট ও পারফরমেন্স বোনাস দিয়েছে। বেতনের বিষয়ও আমরা সমন্বয় করছি। এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি। তবে ব্যাংকটির কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর বোনাস ও ইন্সেন্টিভ সমস্যার সমাধান আসলেও এখনো ১৬ শতাংশ বেতনের বিষয়ে সমাধান হয়নি।
এদিকে বিভিন্ন মহলের সমালোচনা সত্ত্বেও কর্মীদের বেতন-ভাতা ১৫ শতাংশ কমায় বেসরকারি এক্সিম ব্যাংক। ৪০ হাজার টাকার বেশি বেতন পান, এমন কর্মীদের বেতন-ভাতা ১৫ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় পর্ষদ। চলমান সংকটে ব্যাংক বাঁচাতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানায় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ।
দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে ব্যাংকারদের বেতন-কাঠামো এমনিতেই বেশি ছিল। ১৫ শতাংশ বেতন কমালে ব্যাংকারদের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয় এমনটাই জানান ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। দীর্ঘদিন বেতন কম দেওয়ার পর গত মাস থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ সমন্বয় করেছে ব্যাংকটি। তবে এখনো সাড়ে ৭ শতাংশ কম বেতন পাচ্ছেন ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক্সিম ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, গত অর্থবছর থেকেই বেতন ১৫ শতাংশ কম দিচ্ছে। সর্বশেষ গত মাসে সাড়ে ৭ শতাংশ সমন্বয় করেছে। কিন্তু মহামারির মধ্যে ব্যাংকটি মুনাফা হওয়ার পরেও এখনো সাড়ে ৭ শতাংশ বেতন কম দিচ্ছে। গত বছরের মে মাস থেকেই এন্ট্রি লেভেল থেকে এমডি পর্যন্ত ৩ ও ৫ শতাংশ হারে বেতন-ভাতা কমানোর ঘোষণা দেয় এবি ব্যাংক। মহামারির ওই সময় বিভিন্ন কারণে শতাধিক কর্মী ছাঁটাইও করে ব্যাংকটি। কর্মকর্তারা জানান, বেতন-ভাতা কমানোর ঘোষণা দিলেও কমায়নি। তবে কর্মীদের ইনক্রিমেন্ট দেয়নি ব্যাংকটি।
মহামারির ক্ষতি মোকাবেলার নামে বিভিন্ন স্তরে মোট (গ্রোস) বেতনের উপর ১০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক। যা গত বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। নানা মহলেও সমালোচনার মুখে পরের মাসে ওই সিদ্ধান্ত স্থগিত করে দেয় ব্যাংকটি। তবে এখনো ওই আদেশটি প্রত্যাহার করেনি বলে জানান সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।