সাভারের বাইপাইল নতুনপাড়া এলাকায় অবস্থিত তৈরি পোশাক কারখানা এস.বি নিটিং লিমিটেড। গত বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) এই প্রতিষ্ঠানের ছয়জন কর্মকতা সিলেটে বেড়াতে যাবার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। সেই শোক এখনো ছুঁয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি কর্মীর মাঝে। সবার চোখেই যেন হারানো সেসব কর্মীর সঙ্গে কাটানো স্মৃতিময় মুহূর্তগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে।
নিহতরা হলেন কারখানাটির মার্চেন্ডাইজার মীর নাজমুল হক সবুজ (৩০), মো. আল আমীন (২৭), রাজু আহম্মেদ (৩৬), রায়হান সিকদার আরিয়ান (২৪), ডিজাইনার মো. আল আমীন (২৯), ফেব্রিক্স সেকশনের স্টোরকিপার আব্দুল আউয়াল (৩৭) এবং সাদিয়া অ্যাম্বডারি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক বাবুল মোল্লা (৪০)।
ওই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন এই প্রতিষ্ঠানের আরও চার কর্মকর্তা। তারা হলেন, জুবাইদুল ইসলাম মিথুন (২৮), মো. পারভেজ (২৯), মুশফিকুর রহমান দোয়েল (২৪) ও আব্দুল আউয়াল সাকি (৩০)।
সরেজমিনে এস.বি নিটিং লিমিটেডে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিনের মতো প্রতিষ্ঠানটিতে শ্রমিকেরা কাজ করছেন। তবে সবার মাঝেই কেমন যেন একটা বিষাদের ছাপ। সহকর্মীদের নিহতের ঘটনা নিয়ে কথা বলছেন নিজেরা। প্রতিষ্ঠানের মূল ফটকের লোহার গেটে টাঙানো নিহত ছয় কর্মকর্তার ছবি সম্বলিত শোকবার্তার ব্যানারের সামনে দাঁড়িয়ে নিহতদের নিয়ে স্মৃতিচারণ করছেন অনেকে।
তাদের একজন প্রতিষ্ঠানটির নিটিং অপারেটর স্বপন মিয়া। তিনি বলেন, ঘটনার দিন নাইট শিফটে আমার ডিউটি ছিল। কাজের ফাঁকে কারখানার ফটকে এসে দেখি কারখানার মার্চেন্ডাইজার রাজু আহম্মেদ, আল আমীন এবং রায়হান সিকদার ওরফে আরিয়ানকে ব্যাগ হাতে এবং হাফপ্যান্ট ও কেডস পরা অবস্থায়। তারা সবাই মার্চেন্ডাইজার মীর নাজমুল হক সবুজের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এসময় তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলেন- সবুজ এখনো আসছে না কেন? কখন রওনা দেব আমরা। এর একটু পরেই সবুজ তার মোটরসাইকেলে করে সেখানে আসেন এবং মোটরসাইকেলটি কারখানার গেইটের ভেতর পার্কিং করে তারা সবাই মিলে বেরিয়ে পড়েন। পরে রাত আনুমানিক ৪টার দিকে খবর পাই তারা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
অপর অপারেটর আরিফ হোসেন বলেন, নিহত রায়হান সিকদার আরিয়ান আমার আপন খালাতো ভাইয়ের ছেলে। বয়সে আমার জুনিয়র হলেও আমাদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। আমার ছোট ভাইয়ের বিদেশ যাবার ব্যাপারে সে আমাদের ৫০ হাজার টাকা দিয়ে সহায়তাও করেছে। গত বৃহস্পতিবার আরিয়ান আমার ছোটভাইকে ফোন দিয়ে তাদের সাথে সিলেট ঘুরতে যাবার জন্য বলে। কিন্তু আমার ছোটভাই জানায় তার ভিসার মেয়াদ আর অল্প কয়েক দিন আছে। তাই সে তাদের সাথে ঘুরতে যেতে পারবে না। এরপর শুক্রবার সকালে জানতে পারলাম আরিয়ানসহ তার সাথে ঘুরতে যাওয়া আমাদের কারখানার আরও কয়েকজন কর্মকর্তা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় অফিস শেষ করেন প্রতিষ্ঠানটির মার্চেন্ডাইজিং, ডিজাইন ও ফেব্রিকস সেকশনের ১০ কর্মকর্তা। পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে রাত ১১টার দিকে মাইক্রোবাসে করে একই এলাকা থেকে বেড়ানোর উদ্দেশে সিলেটের দিকে রওনা দেন। তাদের সঙ্গে সাদিয়া অ্যাম্বডারি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক বাবুল ও গাড়ির চালক ছিলেন। মাইক্রোবাসটি নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার ঘাসিরদিয়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে পৌঁছালে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা একটি পাথরবোঝাই ট্রাক আরেকটি গাড়িকে অতিক্রম করতে গেলে মাইক্রোবাসটির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলে পাঁচজন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও দুইজনকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।
শুক্রবার বিকেলে নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গ থেকে নিহত ব্যক্তিদের লাশ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করে ইটাখোলা হাইওয়ে পুলিশ। এছাড়া আহত চারজনকে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। আহতরা ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে দুর্ঘটনার পর থেকে মাইক্রোবাস চালকের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক (মানবসম্পদ) মো. জাহিদুর রহমান বলেন, গত মে মাসে মার্চেন্ডাইজার হিসেবে মো. আল আমিন যোগদান করেন। মিষ্টভাষী ও ভদ্র হিসেবেই সবার কাছে পরিচিতি ছিলেন। অমায়িক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে খুব অল্প সময়ে সবার কাছে জায়গা করে নিয়েছিলেন আল আমিন। অন্যান্য যাদের আমরা হারিয়েছি তারা সবাই প্রতিষ্ঠান ও আশপাশের লোকদের কাছে খুবই প্রিয় ছিলেন।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মীর শেহাব উদ্দিন জাকি বলেন, আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটি একটি পরিবারের মতো। এখানে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে সবসময় সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রয়েছে। মালিকপক্ষ আহতদের এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যদের জন্য সবধরনের সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ নিচ্ছেন। আমরা একসঙ্গে ছয়জন সহকর্মীকে হারিয়েছি। এটা মেনে নেওয়া ভীষণ কষ্টের। আহতদের চিকিৎসার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের মালিক নিজে খোঁজখবর নিচ্ছেন। এছাড়া আমাদের প্রতিষ্ঠানে গ্রুপ বিমা করা আছে।