এর মাঝেই রোববার (২০ আগস্ট) বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতীয় প্রভাবশালী দৈনিক দ্য হিন্দু। সাংবাদিক প্রণয় শর্মার ওই প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচনে যদি শেখ হাসিনা হেরে যান, তাহলে বাংলাদেশ দীর্ঘকালীন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মুখোমুখি হতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার যদি ক্ষমতা হারায়, তাহলে এতে ‘চিন্তিত’ হয়ে পড়বে ভারত। সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহিংসতাও বৃদ্ধি পেতে পারে।
প্রণয় শর্মা লিখেছেন, প্রতিবেশীদের মধ্যে যে ভারতবিরোধী মনোভাব আছে সেখানে শেখ হাসিনার সরকার খুব সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে নির্ভরশীল ও ঘনিষ্ঠ মিত্র। তবে যদিও ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ায় ‘বিগ পাওয়ার’ হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাদের এই অবস্থানে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে চীন। আর বছর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় চীন তাদের অবস্থান শক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে এরপর বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দৌড়ঝাঁপ করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছে এবং জানুয়ারিতে একটি সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক নির্বাচন নিশ্চিতে চেষ্টা করছে। এর অংশ হিসেবে নির্বাচনে কারচুপির চেষ্টাকারীদের ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, র্যাবের বিরুদ্ধে গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ে সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন। এরমাধ্যমে তিনি নিজের অবস্থান শক্ত করেছেন এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড গড়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় বলেছেন, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে। তবে তা সত্ত্বেও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দলীয় নেতাকর্মী, সরকারি সংস্থা ও কর্মকর্তাদের লাগাম টেনে ধরতে তার ওপর চাপ দিচ্ছে পশ্চিমারা। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে। যেখানে নির্বাচনে অংশ নেওয়া এক স্বতন্ত্রপ্রার্থীর ওপর হামলা চালায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ওই হামলার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কঠোর ভাষায় বাংলাদেশের সরকারের সমালোচনা করে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার আয়োজিত গণতান্ত্রিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানাননি। যেখানে ভারত-পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এছাড়া গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব ব্যাংকের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়ার পর বাইডেন প্রশাসন যে তাকে উপেক্ষা করেছিল সেটিও উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন, বাইডেন বাংলাদেশের গণ্তন্ত্রকে রক্ষা নয়, ধ্বংস করতে কাজ করছেন। একবার সংসদে তিনি বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের যে কোনো দেশের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে, বিশেষ করে যদি এটি মুসলিম দেশ হয়।’
দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো উপকৃত হয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) অবাধে সরকারবিরোধী সমাবেশ করছে। এছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠন— যেমন ইসলামপন্থি দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও, যেটির সঙ্গে পাকিস্তানের ভালো সম্পর্ক রয়েছে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছে— যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবস্থানের কারণে রাজনৈতিক প্রাণচঞ্চলতা ফিরে পেয়েছে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতের কয়েকজন নেতাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ বন্ধ করেছে। সেই জামায়াতও গত ১০ বছরের মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বড় সমাবেশ করেছে। এরপর বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর একটি বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। আমির খসরু বলেছিলেন, ‘যদি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়, তাহলে আওয়ামী লীগ ধ্বংস হয়ে যাবে।’
তবে ভারতের শঙ্কা— জামায়াত ও তাদের সমমনা দলগুলো নিয়ে বিএনপি বাংলাদেশে শাসন পরিচালনা করবে— এমন সম্ভাবনা ঢাকা ও দিল্লিতে উদ্বেগ ও শঙ্কা তৈরি করেছে।
হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দশকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি শক্তিশালী, বিশ্বস্ত এবং নির্ভরতার সম্পর্ক তৈরি করেছেন। যা দুই দেশের জন্যই মঙ্গলজনক। ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপির নেতাদের মুসলিম-বিদ্বেষী এবং বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্যকে শেখ হাসিনা যে পাত্তা দেননি— এরমাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে।
প্রতিবেদনে সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর একটি বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে। ওই বক্তব্যে সাবের হোসেন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ থেকে একটি সহযোগিতা এবং নিরাপত্তামূলক সম্পর্কে পরিণত হয়েছে। যেই সম্পর্কে সরাসরি যোগাযোগ একটি প্রভাবক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।’
সাবের হোসেন চৌধুরী আরও বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারত সরকার দুই পক্ষের মধ্যে একটি উইন-উইন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এবং উভয় দেশের সরকারই উন্নতির ক্ষেত্রে একে-অপরের ওপর নির্ভরশীল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন, বাইডেন বাংলাদেশের গণ্তন্ত্রকে রক্ষা নয়, ধ্বংস করতে কাজ করছেন। একবার সংসদে তিনি বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের যে কোনো দেশের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে, বিশেষ করে যদি এটি মুসলিম দেশ হয়।’
দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার এই সম্পর্কের মাধ্যমে ভারত এমন একটি উদাহরণ তৈরি করতে সম্মত হয়েছে— যেখানে দেখা যাচ্ছে ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলে প্রতিবেশীরা কীভাবে সুফল পেতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সহায়তা করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরি ও বাংলাদেশ থেকে ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা এসব বন্ধ করেছেন।
তারপরও ঢাকা ও নয়াদিল্লির শঙ্কা— যুক্তরাষ্ট্র এখন যে অবস্থান নিচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ ও ভারতের এ সম্পর্ক হুমকির মুখে পড়তে পারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে। কিন্তু কোথাও যদি তাদের কৌশলগত সম্পর্ক জড়িত থাকে তাহলে এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে কেন তারা এতটা মাথা ঘামাচ্ছে সেটির কারণ জানা উচিত।
এ ব্যাপারে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগতভাবে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র নৌকায় ঝাঁকুনি দিতে পারছে। বাংলাদেশ মার্কিনিদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, কিন্তু কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে কারণে বাইডেন প্রশাসন নির্বাচন নিয়ে এখন বাংলাদেশকে চাপ দিতে পারছে।
দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশের অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন হয়েছে, এটি বাংলাদেশে স্বীকার করে নেওয়া হয়। ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ গত দশকে ৭ শতাংশ বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির রেকর্ড গড়েছে। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সামাজিক উন্নতির বিভিন্ন সূচকও ভালো।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখেছে— স্বাধীনতার শুরুতে যেখানে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম গরীব দেশ ছিল সেখান থেকে অন্যতম দ্রত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ।
ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিবাদমান দেশগুলোর পক্ষ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের ওপর অবস্থিত, যেটি ভারত মহাসাগরের অংশ। এই ভারত মহাসাগর পরিবহনক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের মোট বাণিজ্যের ৮০ শতাংশই এখান দিয়ে হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ‘আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বহুপাক্ষিক ব্যবস্থা’ ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি ‘ন্যায়সম্মত ও শক্তিশালী উন্নয়নের’ ওপর জোর দেয়। সঙ্গে এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার নীতিও রয়েছে বাংলাদেশের।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও চীনের ‘লড়াইয়ের ক্ষেত্রে’ পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। এই দুই দেশই বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করায় বিষয়টি আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীনের দীর্ঘ বৈরিতার প্রভাবও পড়েছে বাংলাদেশে।
বাংলাদেশি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাবাব ইনাম খান হিন্দুকে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের বিশাল বাণিজ্যিক স্বার্থ আছে, যার মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক খাতও।’ তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও শ্রমের ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে।’
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সম্পর্কের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে চীন। গত জুনে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়েং ওয়েনবিন এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে কঠোরভাবে সমর্থন করি।’ চীন আরও বলেছে, তারা বাংলাদেশের স্বাধীন নীতি ও উন্নয়নের পথকে সমর্থন জানায়, যেটি বাংলাদেশের সঙ্গে যায়।
তবে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে ভারতের জন্য উভয় সংকট হিসেবে দেখা হচ্ছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ভালো সম্পর্কের মাধ্যমে একটি আশার সঞ্চার হয়েছে— সেটি হলো তারা শেখ হাসিনার পক্ষে বাইডেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। আর চীন এখন ঢাকার পক্ষে থাকায় একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে সম্পর্ক রয়েছে সেটি কাজে লাগিয়ে শেখ হাসিনাকে সহায়তায় কাজ করছে ভারত। কিন্তু যদি এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে তারা মানাতে না পারে, তাহলে তা ভারতের জন্যই ক্ষতিকর হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়, তাহলে নয়াদিল্লিকে একটি বিরোধী শক্তি মোকাবিলা করতে হবে। ভারত এই বিষয়টি নিয়ে ভীত। কিন্তু চীনের সঙ্গে বিএনপিরও ভালো সম্পর্ক আছে। ফলে ক্ষমতা পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশে চীনের স্বার্থে খুব বড় কোনো প্রভাব পড়বে না।
লন্ডনের এসওএএস বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ও দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ অভিনাশ পালিওয়াল বলেন, ‘ভারতের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো শেখ হাসিনা এখন ক্ষমতাবিরোধী পরিস্থিতিতে পড়েছেন এবং বিএনপি রাজনৈতিক মোমেন্টাম পাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হয়, তাহলে এই চ্যালেঞ্জটি ভারতের জন্য আরও কঠিন হয়ে যাবে।’
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চলে গেছে। কারণ তিনি চীনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করেছেন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ সাহাব ইনাম খান বলেন, বর্তমান বিতর্কের মূল কেন্দ্রে আছে চীন। ২০২৩ সাল থেকে বাংলাদেশে চীনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বেড়েই চলছে। যার শুরুটা হয় ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে।
বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (ব্রি) যোগ দেওয়ার পর বেইজিংয়ের কাছ থেকে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে। এছাড়া চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যবসায়িক বন্ধুও। বর্তমানে সিনো-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ২৫ বিলিয়ন ডলার। যেখানে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসার পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলার আর ভারতের সঙ্গে ১৮ বিলিয়ন ডলার।
অবশ্য বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্কের মূলে আছে প্রতিরক্ষা খাত। এই সম্পর্ক শুরু হয় ১৯৮০ সাল থেকে। বর্তমানে বাংলাদেশের সামরিক প্রয়োজনীয়তার ৭২ শতাংশ মেটায় চীন। এমনকি পাকিস্তানের পর বাংলাদেশই চীনের সবচেয়ে বড় সামরিক পণ্য আমদানিকারক দেশ।
তবে বাংলাদেশের সামরিক খাতে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির বিষয়টি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের জন্যই চিন্তার বিষয়। ভারতের অনুরোধে চীনকে শেখ হাসিনা সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি করতে দেননি। এর বদলে বর্তমানে তিনি কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে জাপানকে গভীর সমুদ্রের বন্দর তৈরির জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
গত মার্চে শেখ হাসিনা পেকুয়ায় বাংলাদেশের প্রথম সাবমেরিন ঘাঁটি উদ্বোধন করেন। যা বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া চ্যানেলের কাছে অবস্থিত। এটি তৈরি করা হয়েছে ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার খরচ করে। এই ঘাঁটি চীন থেকে আনা দুটি সাবমেরিনের ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হবে। যদিও এই ঘাঁটি পরিচালনা ও বাংলাদেশের সেনাদের প্রশিক্ষণ দেবে চীন। তবে চীনের নৌবাহিনী যেন এটি তাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার না করে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছে ঢাকা।
আরেকটি তথ্য হলো— ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে ২ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের অস্ত্র কিনেছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিনেছে মাত্র ১২৩ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে একটি শক্তিশালী সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। তারা বাংলাদেশে ফ্রিগেট এবং সামরিক পরিবহন বিমান দিয়েছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে দুটি চুক্তি করতে চায়। সেগুলো হলো— দ্য জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি এগ্রিমেন্ট এবং একুইজিসন অ্যান্ড ক্রস সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট। এরমাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহায়তা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এ চুক্তিগুলো করতে বাংলাদেশের কোনো তাড়া নেই।
তবে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, এসব চুক্তি সামরিক সম্পর্ক শক্তিশালী করবে এবং সামরিকবিষয়ক বাণিজ্য, তথ্য আদান-প্রদান এবং সেনাদের মধ্যে সহায়তা বৃদ্ধি করবে। লন্ডনের এসওএএস বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক অভিনাশ পালিওয়াল বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাস শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশকে চীনের প্রতি আরও সংবেদনশীল করে তুলবে এবং তাদের বিশ্বাস বিএনপি চীনের প্রভাব বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনের শেষ দিকে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা যদি নির্বাচনে হেরে যান, তাহলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা দীর্ঘায়িত হতে পারে। এমনকি আবারও বাংলাদেশ উগ্রবাদীদের আতুর ঘরে পরিণত হতে পারে। ফলে বিষয়টি শুধু ভারত নয় পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।