নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ‘মা সাইন প্রিন্টিং প্রেসে’ বড় ভাই আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে কাজ করতেন জহিরুল ইসলাম (৩৮)। গত মার্চে দোকানের পাশ থেকে নিখোঁজ হন তিনি। এক মাস পর পরিবার জানতে পারে জহিরুল মিয়ানমারে বন্দী। মুক্তিপণ হিসেবে চাওয়া হয় ছয় লাখ টাকা। হতবিহবল পরিবার অনেক কষ্টে চার লাখ ২০ হাজার টাকা ইসলামী ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টে পাঠান। এরপর বিকাশে আরও টাকা পাঠান। তবুও পাচারকারী চক্রের মন গলেনি। জহিরুলকে জীবিত ফেরত চাইলে দিতে বলা হয় আরও মোটা অঙ্কের টাকা। একপর্যায়ে নগদ টাকা নিতে এসে চলতি বছরের এপ্রিলে চক্রের আবুল নামে এক সদস্য পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর আড়াইহাজার থানায় মানবপাচারের একটি মামলা করেন জহিরুলের বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ।
এই খবরে জহিরুলের ওপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। জানানো হয়, জহিরুল আর জীবিত ফিরবে না। পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারে, শুধু জহিরুল নয়, মালয়েশিয়ায় উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলা থেকে মোট ১৯ জন যুবককে মিয়ানমারে আটকে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। পরে এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের বাংলাদেশের হোতা মো. ইসমাইল ও তার দুই সহযোগীকে আটক করে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। মিয়ানমারের এক নাগরিকের যোগসাজশে এই চক্র গড়ে তোলেন ইসমাইল। চক্রের সদ্যদের খপ্পরে পড়ে ভাগ্য পরিবর্তন ও উন্নত জীবনযাপনের আশায় মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছা পোষণ করেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার ২২ যুবক।
পরে তাদের কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ট্রলারযোগে মিয়ানমার নেয়া হয়। পরে সেখানে তাদের নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় করে একটি চক্র। মিয়ানমার থেকে ট্রলারে পাচারকালে ১৯ যুবককে মিয়ানমার কোস্টগার্ড আটক করে। বাকি তিন যুবক অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পৌঁছে যায়। কিন্তু পাচারকারী চক্রের নির্যাতনে মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর ভুক্তভোগী যুবক জহিরুল ইসলাম মারা যান। বাকি দুই যুবক অবৈধভাবে বর্তমানে মালয়েশিয়ায় রয়েছে।
শনিবার (১৯ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাতে নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই চক্রের বাংলাদেশি ৩ সদস্যকে আটক হয়। আটক তিনজন হলেন চক্রের হোতা মো. ইসমাইল ও তার সহযোগী জসিম এবং মো. এলাহী। এদের মধ্যে ইসমাইল গত ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত মালয়েশিয়া অবস্থানকালে মিয়ানমারের আরাকানের নাগরিক (রোহিঙ্গা) রশিদুল ও জামালের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং সখ্যতা গড়ে উঠে। পরে ইসমাইল দেশে ফিরে এসে রশিদুল ও জামালের যোগসাজশে ১০ থেকে ১২ জনের একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র গড়ে তোলেন।
এছাড়া তিনি স্থানীয় এজেন্টদের যোগসাজশে বাংলাদেশে মানব পাচার চক্রটির শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকার তরুণ ও যুবকদের কোনো প্রকার অর্থ ও পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পৌঁছানোর আশ্বাস দেন। মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পরে কাজ করে তিন লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে এমন প্রলোভন দেখিয়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকার ২২ যুবককে পাচার করে। এরপর মিয়ানমারে তাদের আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করতে অমানবিক নির্যাতন চালায়।
খন্দকার আল মঈন বলেন, ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে আদায় করা তিন লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে আটক ইসমাইল, জসিম ও আলম ৩০ হাজার টাকা করে নেন। চক্রের অন্য সদস্যরা ১০ হাজার টাকা করে পেতেন এবং বাকি দুই লাখ ২০ হাজার টাকা মালয়েশিয়া অবস্থানরত রশিদুলের কাছে মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠান ইসমাইল। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। এছাড়া ইতোমধ্যে তিনি কারাভোগও করেছেন। আটক জসিম ও এলাহী চক্রটির অন্যতম সহযোগী। তারা নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করে বিভিন্ন এলাকা থেকে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক প্রত্যাশীদের সংগ্রহ করে ইসমাইলের কাছে নিয়ে আসতেন। তাদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলাও রয়েছে। আসামির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।