নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে জঙ্গিবাদ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন চার যুবক। কথিত জিহাদে অংশ নিতে পাহাড়ে গিয়েছিলেন তারা। এরপর নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সাবেক এই চার সদস্যের মধ্যে কম্পিউটার প্রকৌশলে অধ্যয়নরত, মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করা এবং মেকানিক রয়েছেন।
বুধবার (৯ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে র্যাবের মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এই তথ্য জানিয়েছেন।
স্বাভাবিক জীবনে ফেরা ওই যুবকরা হলেন, আবু বক্কর ওরফে রিয়াসাদ রাইয়ান (১৬), হাসান সাইদ (২৬), শেখ আহমেদ মামুন (২৩) ও ইয়াছিন (২১)।
তাদের মধ্যে আবু বক্করের মা একজন বিমানকর্মী। তিনি প্রথমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন। পরে ‘জিহাদে’ অংশগ্রহণ করতে ছেলে আবু বক্করকে পাঠান। এরপর নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজে ফিরে আসেন। একই সঙ্গে সংবাদ সম্মেলন করে ছেলেকে ওই ভুল পথ থেকে ফিরে আসতে বলেন। একপর্যায়ে মায়ের আকুতিতে নিজের ভুল বুঝতে পেরে আত্মসমর্পণ করেন।
র্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন জানান, ওই চার যুবক মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে র্যাব-১১ এর কার্যালয়ে হাজির হন। সেখানে তাদের পরিচয় দিয়ে জঙ্গি সংগঠনের সদস্য ছিলেন বলে জানান। তারা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণের জন্য আইনি সহায়তা চান। পরে তাদের আইনি সহায়তা দেওয়ার আশ্বাসে আটক করা হয়।
তিনি জানান, স্বেচ্ছায় হাজির হওয়া ৪ জনকে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
যেভাবে জঙ্গিবাদে জড়ায়
র্যাব জানিয়েছে— মূলত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতদের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন তারা। এরপর যোগ দেন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ায়। এই সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা তাদের ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাহাড়ে যেতে আগ্রহী করে তোলেন। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফের সহযোগিতায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণে যুক্ত হন। এরপর তাদের বিভিন্ন কার্যক্রম দেখে ভুল ভাঙে তাদের। বেশ কয়েকজন স্বাভাবিক জীবনে আসতে চাইলেও তাদের ফিরতে দেওয়া হয়নি। এজন্য তাদের বন্দি রেখে নির্যাতন করা হয়।
র্যাবের মিডিয়া উইং পরিচালক জানান, ফিরে আসা চারজনকে দিয়ে রশদ পরিবহন, রান্না, প্রশিক্ষণের গর্ত খোঁড়া ও ঘর বানানোসহ বিভিন্ন কাজ করানো হতো। ২০২২ সালের জুনে সিপ্পি পাহাড় থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় কেএনএফ সদস্যদের কাছে ধরা পড়েন তারা। এরপর তাদের বন্দি করে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়। আবার পালানোর চেষ্টা করা হলে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। পাহাড়ে র্যাবের অভিযান শুরু হলে তারা আবার পালানোর পথ খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে মার্চের প্রথম দিকে পালিয়ে সমতলে চলে আসেন তারা। এরপর চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে থাকেন। বিভিন্ন সময় পরিবারের সঙ্গে যোগযোগ করলে তারা র্যাবের কাছে যাওয়ার উৎসাহ দেন। পরে তারা পরিবারের কথায় আশ্বস্ত হয়ে র্যাবের নারায়ণগঞ্জ ব্যাটালিয়নে হাজির হন।
খন্দকার আল মঈন বলেন, ২০২১ সালে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন আবু বক্করের মা। ২০২২ সালে কথিত জিহাদে ছেলেকে পাহাড়ে পাঠান। এরপর নিজের ভুল বুঝতে পেরে ছেলেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আহ্বান জানান।
র্যাবের দেওয়া তথ্যমতে— ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৭৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া পাহাড়ে অবস্থান, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কার্যক্রমে জঙ্গিদের সহায়তার জন্য কেএনএফের ১৭ জন নেতা ও সদস্যকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়।
স্বাভাবিক জীবনে ফেরা চার যুবকের পরিচয়
আবু বক্কর ওরফে রিয়াসাদ রাইয়ান নারায়ণগঞ্জের একটি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। ২০২১ সালে আল আমিন নামে তার এক শিক্ষকের মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ায় যোগ দেন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১২ জনের দলের সাথে তৃতীয় ব্যাচে ‘হিজরত’ করতে পাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সেখানে যাওয়ার পর তার ভুল ভাঙে। পরে পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলেও প্রশিক্ষণের দায়িত্বে থাকা সদস্যরা তাকে যোগাযোগ করতে দেয়নি। আবু বক্করের মা ইতোপূর্বে তাকে দেশের জন্য হুমকির কাজ, বিশৃঙ্খলা, নৃশংসতা ও অন্যায় কাজে সামিল না হতে অনুরোধ করে ফিরে আসার আহ্বান জানান।
হাসান সাঈদ (২৬) স্থানীয় মাদরাসা থেকে দাওরা হাদিস সম্পন্ন করেন। ২০২১ সালে শূরা সদস্য মায়মুনের মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হন। একই বছরের নভেম্বরে ‘হিজরত‘ করতে পাহাড়ে যান। সেখানে তিনি ভুল বুঝতে পারেন। এরমধ্যে সাঈদসহ ৪-৫ জন দুই বার পালাতে চেয়েও ধরা পড়েন।
শেখ আহমেদ মামুন (২৩) সিলেটের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রকৌশল বিষয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন। ২০২১ সালে তিনি সাঈদের মাধ্যমে এই সংগঠনে যোগ দেন। একই বছর নভেম্বরে মামুন, সাঈদ ও আরও বেশ করয়েকজন পাহাড়ে যান। সাঈদের সাথে তিনিও দুই বার পাহাড় থেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন এবং নির্যাতনের স্বীকার হন।
ইয়াসিন (২১) এলাকায় ঘড়ি মেকানিক হিসেবে কাজ করতেন। ২০২১ সালে সিরাজের মাধ্যমে ওই সংগঠনে যোগ দেন। একই বছরের নভেম্বরে পাহাড়ে চলে যান। পার্বত্য অঞ্চলে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কার্যক্রম দেখে তিনিও ভুল বুঝতে পারেন।