পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে একটি দুর্নীতির মামলায় তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার সময় তিনি যেসব রাষ্ট্রীয় উপহার পেয়েছিলেন, সেগুলো বিক্রি করে পাওয়া অর্থ সম্পর্কে ঘোষণা না দেওয়ার কারণে ইসলামাবাদের বিচারিক আদালত এই রায় দেয়। এরপরই তাকে শনিবার গ্রেফতার করে কারাগারে নেওয়া হয়েছে।
শনিবার ইমরান খানকে তার লাহোরের বাড়ি জামান পার্ক থেকে গ্রেফতার করা হয়। সেখান থেকে তাকে নেওয়া হয় লাহোরের কোট লখপাত কারাগারে। এরপর তাকে নেওয়া হয়েছে ইসলামাবাদের আদিয়ালা কারাগারে। এখানেই প্রাথমিকভাবে রাখা হবে ইমরান খানকে। কারাগারটির নিরাপত্তা কয়েকগুণ বাড়ানো হয়েছে। ইমরানের সমর্থকেরা যেন সেখানে ভিড় না করতে পারেন, সে জন্য কারাগারটির আশপাশের রাস্তাগুলোতে ব্যারিকেডও দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে পাকিস্তানের বাণিজ্যবিষয়ক সংবাদমাধ্যম এমএম নিউজ জানিয়েছে, ইমরান খানকে বেলুচিস্তানের মাচ কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হতে পারে। রাজনৈতিক বন্দীদের রাখার জন্য কারাগারটি ব্রিটিশ আমল থেকেই কুখ্যাত। ব্রিটিশ আমলের পর বিশেষ করে সামরিক শাসনামলে গ্রেফতার হওয়া শীর্ষ রাজনীতিবিদদের এই কারাগারে রাখা হতো।
এই কারাগারের সবচেয়ে কুখ্যাত ওয়ার্ড বিবেচনা করা হয় ৯ নম্বর ওয়ার্ডকেই। কুখ্যাতির জন্য উর্দু ভাষায় ওই ওয়ার্ডটিকে বলা হয় ‘মির্চি’ বা মরিচ ওয়ার্ড। ওই ওয়ার্ডটি কেন ‘মির্চি’ ওয়ার্ড হিসেবে পরিচিত হলো তারও ইতিহাস রয়েছে।
সম্প্রতি আশঙ্কা প্রকাশ করে ইমরান খান জানিয়েছিলেন যে, তাকে গ্রেফতার করে মাচ কারাগারে রাখার পরিকল্পনা করছে সরকার। এর আগে গত বছরের নভেম্বরে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ খান বলেছিলেন যে, যদি ইমরানকে গ্রেফতার করা হয় তবে তাকে মাচ কারাগারেই রাখা হবে। শুধু তাই নয়, ওই জেলের কোন ওয়ার্ডে ইমরানকে রাখা হবে তা-ও উল্লেখ করেছিলেন তিনি। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ইমরান খানের সম্ভাব্য ঠিকানা হতে পারে মাচ কারাগারের ৯ নম্বর ওয়ার্ড।
পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ বেলুচিস্তান। এটি স্থলভাগের দিক থেকে পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ হলেও জনসংখ্যা সবচেয়ে কম এবং বেশিরভাগ এলাকা দুর্গম। প্রদেশটির রাজধানী কোয়েটা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে দুর্গম এলাকায় অবস্থিত মাচ কেন্দ্রীয় কারাগার। ১৯২৯ সালে ব্রিটিশ আমলে এটি তৈরি হয়েছিল। শুধু কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থাই নয়, দেশটির সবচেয়ে কুখ্যাত কারাগার হিসেবেও এর পরিচিতি রয়েছে।এই কারাগারের সবচেয়ে কুখ্যাত ওয়ার্ড বিবেচনা করা হয় ৯ নম্বর ওয়ার্ডকে। কুখ্যাতির জন্য উর্দু ভাষায় ওই ওয়ার্ডটিকে বলা হয় ‘মির্চি’ বা মরিচ ওয়ার্ড। কেন ওই ওয়ার্ডটি ‘মির্চি’ ওয়ার্ড হিসেবে পরিচিত হলো তারও ইতিহাস রয়েছে।
তথ্য বলছে, আগেও ওই ওয়ার্ডে হাই-প্রোফাইল অনেক রাজনৈতিক বন্দীদের রাখা হয়েছিল। তাদের বেশির ভাগই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ কিংবা আন্দোলন করে কারাবরণ করেছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলেন, নবাব আকবর বুগতি, নবাব খায়ের বখশ মারি, সরদার আত্তাউল্লাহ মেঙ্গল, সাদিক ইমরানি এবং সাংবাদিক সিদ্দিক বালুচ প্রমুখ।
কারাগারটির অবস্থান অনেক দূরবর্তী এবং প্রচণ্ড গরম এলাকায় হওয়ায় এটিকে কুখ্যাত আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সেলুলার কারাগারের সঙ্গে তুলনা করা হয়। জানা যায়, ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ কিংবা আন্দোলন করে যারা ধরা পড়তেন তাদের বেশিরভাগেরই ঠিকানা হতো ওই মাচ কারাগার।
আরও জানা যায়, যেসব বন্দীরা নত হতে রাজি হতেন না তাদের জন্য কারাগারের একপ্রান্তে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় তৈরি হয়েছিল ৯ নম্বর বা মির্চি ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডে বন্দীদের খাবারে সাধারণত বেশি করে মরিচ বা ঝাল দেওয়া হতো, যেন খেতে গিয়েও তারা খুব কষ্ট পান। এর থেকেই এই ওয়ার্ডটি মরিচ ওয়ার্ড হিসেবে পরিচিতি পায়।
যা বললেন ইমরান খান
গ্রেফতার হওয়ার পর ইমরান খানের আগে থেকে রেকর্ড করা বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বক্তব্যে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার সমর্থকদের একটি বার্তা দিয়েছেন।
পিটিআই চেয়ারম্যান ইমরান খান তার সমর্থকদের বলেছেন, ‘আপনারা অধিকার না পাওয়া পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করুন।’তিনি বলেন, ‘যখন আপনি এই বিবৃতিটি শুনবেন, তখন তারা আমাকে গ্রেফতার করবে। আমার একটাই আবেদন- চুপচাপ ঘরে বসে থাকবেন না। (মনে রাখবেন) আমি আপনার জন্য, দেশের জন্য এবং আপনার সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রাম করছি।’
ইমরান খানের ওপর ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় দখলে থাকা উপহার সামগ্রি বিক্রি করার অভিযোগ আনা হয়। মামলায় উপহারগুলোর বিক্রয় মূল্য দেখানো হয়েছে ৬ লাখ ৩৫ হাজার ডলার।
ইমরান খানের তোশাখানা মামলা কী?
তোশাখানা মূলত একটি ফার্সি শব্দ যার মানে গুপ্তধন রাখার ঘর। পাকিস্তানে ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত তোশাখানা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের অধীনে একটি বিভাগ। অন্যান্য সরকার ও রাজ্যের প্রধান এবং বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে দেশটির শাসক, সংসদ সদস্য, আমলা এবং কর্মকর্তাদের দেওয়া মূল্যবান উপহার সামগ্রির সংরক্ষণশালা হিসেবে ব্যবহার করা হয় এই তোশাখানা।
তোশাখানায় বুলেটপ্রুফ গাড়ি, সোনার ধাতুপট্টাবৃত স্যুভেনির এবং দামী পেইন্টিং থেকে শুরু করে ঘড়ি, অলঙ্কার, পাটি এবং তলোয়ারের মতো মূল্যবান জিনিস সংরক্ষিত রয়েছে।
তোশাখানা পরিচালনাকারী নিয়মের অধীনে সরকারি কর্মকর্তারা শর্ত মেনে কমদামি কিছু উপহার নিজেদের কাছে রাখতে পারবেন। কিন্তু ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন প্রাপ্ত উপহারগুলো অপ্রত্যাশিত মূল্যে কিনেছেন এবং অতিরিক্ত লাভের আশায় তা খোলা বাজারে বিক্রি করেছেন, এমন অভিযোগের পর থেকেই তোশাখানা মামলা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
সাবেক ক্রিকেট তারকা থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া ৭০ বছর বয়সী ইমরান খানের ওপর ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় দখলে থাকা উপহার সামগ্রি কেনা-বেচা করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। মামলায় উপহারগুলোর বিক্রয় মূল্য দেখানো হয়েছে ৬ লাখ ৩৫ হাজার ডলার।
সরকারি কর্মকর্তাদের মতে, উপহারের মধ্যে ছিল রাজপরিবারের দেওয়া ঘড়ি। তারা আগে অভিযোগ করেছে যে ইমরান খানের সহযোগীরা সেগুলো দুবাইতে বিক্রি করে দিয়েছে। এছাড়াও উপহারের মধ্যে সাতটি হাত ঘড়ি, যার মধ্যে ছয়টি রোলেক্সের তৈরি এবং সবচেয়ে দামি একটি ‘মাস্টার গ্রাফ লিমিটেড সংস্করণ’ ছিল যার মূল্য ৩ লাখ ৮৫ হাজার ডলার।