সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল ভবনে হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। রিপাবলিকান এই রাজনীতিবিদ এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং এই মামলাকে তিনি “উদ্ভট” বলে উল্লেখ করেছেন।
তার বিরুদ্ধে আরও দু’টি মামলা দায়ের করা হয়েছে- দেশের গোপনীয় দলিলপত্র তিনি নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন এবং একজন পর্ন তারকাকে ঘুষ দেওয়ার বিষয়টি গোপন রাখার জন্য তিনি তথ্য জাল করেছেন এমন অভিযোগে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দায়ের করা এসব মামলাকে ঘিরে যেসব প্রশ্ন ওঠেছে এখানে তার কয়েকটির ওপর আলোকপাত করা হলো।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ
ট্রাম্প ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে পরাজিত হন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে তিনি ওই নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ আনা হয়েছে:
ক. যুক্তরাষ্ট্রকে প্রবঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র
খ. একটি সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার ষড়যন্ত্র
গ. একটি সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টি করা
ঘ. নাগরিকের অধিকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন (৩রা নভেম্বর) থেকে ২০শে জানুয়ারি হোয়াইট হাউজ ছেড়ে যাওয়ার দিন পর্যন্ত দুই মাসেরও বেশি সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কিছু কর্মকাণ্ডের জের ধরে এসব অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে ভোট পড়ার পর সেগুলো সংগ্রহ, গণনা ও ফলাফল অনুমোদন করার প্রক্রিয়ায় তিনি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় অভিযোগে বলা হচ্ছে যে তিনি ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ইলেকটোরাল কলেজের ভোটের ফলাফল অনুমোদন করার প্রক্রিয়ায় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যার জের ধরে ক্যাপিটল ভবনে দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে।
চতুর্থ অভিযোগ হচ্ছে তিনি নাগরিকদের ভোট দেওয়ার অধিকারে এবং তাদের ভোট গণনা করার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছেন।
আগের অভিযোগের তুলনায় এই মামলা কতোটা গুরুতর?
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এটা তৃতীয় অভিযোগ এবং আইন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে এটাই হয়তো সবচেয়ে শক্তিশালী মামলা নয়।
তবে মামলার ওজনের দিক থেকে এসব অভিযোগ সবচেয়ে গুরুতর এবং এসবের পরিণতিও অনেক বেশি হতে পারে, বলেন সাংবাদিক স্যারাহ স্মিথ।
তিনি বলেন, এই প্রথম এমন কিছু ঘটনার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে যেগুলো তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে থাকার সময়ে ঘটেছে।
এসব ঘটনার প্রভাব এই বাস্তব-পৃথিবীতেই পড়েছে যা তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে তুলে ধরা হয়েছে। এরকম আমরা অন্য মামলাগুলোর বেলায় দেখিনি।
সাবেক একজন সরকারি ফেডারেল আইনজীবী রেনাতো মারিওত্তি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম সাবেক একজন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এ ধরনের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করা হলো।
এসব অভিযোগের অর্থ হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্প “ক্ষমতায় থেকে যাওয়া এবং ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।”
এর পরে কী হবে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটন ডিসির আদালতে হাজির হওয়ার কথা রয়েছে। তিনি শারীরিকভাবে সেখানে উপস্থিত থাকবেন নাকি দূর থেকেই তাতে যোগ দেবেন তা এখনও পরিষ্কার নয়।
এই তদন্তে নেতৃত্ব দানকারী স্পেশাল কাউন্সেল জ্যাক স্মিথ “দ্রুত বিচারের” আহবান জানিয়েছেন। তবে নানান কারণেই এরকম হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আরও যেসব মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে সেগুলোর বিচার অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্যেও সময়ের প্রয়োজন। এসব মামলার বিচার একই সময়ে অনুষ্ঠিত হবে না।
এছাড়াও নির্বাচন চলাকালে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে এসব মামলার আইনি প্রক্রিয়া চলারও সম্ভাবনা নেই। যেমন রিপাবলিকানদের জাতীয় সম্মেলন যেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী বাছাই করা হবে।
মারিওয়ত্তিও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থায় এমন অনেক উপায় রয়েছে যার ফলে কোনো একটি মামলার বিচার হতে অনেক সময় লেগে যেতে পারে।
ট্রাম্প কি জেলে যেতে পারেন এবং তারপরেও নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন?
সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বয়স ৭৭ এবং তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে সেগুলো প্রমাণিত হলে কারাদণ্ডের মতো কঠিন শাস্তিও হতে পারে।
এই মামলার বিচার যে বিচারকের তত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হবে সেই টানিয়া চুটকানকে নিয়োগ দিয়েছেন আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ক্যাপিটল হিলে ৬ জানুয়ারি হামলার ঘটনায় দায়ের করা অন্যান্য মামলায় ইতোমধ্যে তিনি কঠোর সাজা দিয়েছেন।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের গোপনীয় দলিলপত্র অব্যবস্থাপনার যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেটা প্রমাণিত হলে তার ২০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
এর আগে মার্কিন রাজনীতিবিদ লিন্ডন লারুশ জালিয়াতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের আইনের অধীনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মোট আটবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুসারে ফৌজদারি অপরাধে কেউ অভিযুক্ত হলে, এমনকি জেলে থাকলেও, তিনি নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন।
তবে তার অর্থ এই নয় যে ভোটাররা এরকম একজন প্রার্থীকে ভোট দেবেন।
এর আগে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্তত দু’জন রাজনীতিবিদ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন।
তাদের একজন ১৯২০ সালের নির্বাচনে সমাজবাদী প্রার্থী ইওজিন ডেবস। ১৯১৮ সালে যুদ্ধবিরোধী ভাষণ দেওয়ার অভিযোগে তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। অন্যজন লিন্ডন লারুশ, জালিয়াতির অভিযোগে যিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। যে আটবার তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন তার মধ্যে ১৯৯২ সালের নির্বাচনের সময় তিনি মিনেসোটার ফেডারেল কারাগারে আটক ছিলেন।
তারা দু’জনই নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন।
নির্বাচনে জয়ী হলে ট্রাম্প কি নিজেকে ক্ষমা করে দিতে পারবেন?
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন দোষী সাব্যস্ত হলে ট্রাম্প হয়তো এই চেষ্টাটা করে দেখতে পারেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের আইনে সম্ভাব্য এই বিষয়টি পরীক্ষিত নয়। এক্ষেত্রে হয়তো সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করতে পারে।
এছাড়াও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে, এই মামলা যদি তখনও চলতে থাকে, তিনি হয়তো মামলাটি খারিজ করে দেওয়ারও চেষ্টা করতে পারেন।
আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন-প্রত্যাশী, আরকানসাসের সাবেক গভর্নর আসা হাচিনসন বলেছেন- এই দুটো ঘটনাই সম্ভব। তবে তিনি বলেন, নিজেকে নিজে ক্ষমা করার বিষয়টি “সংবিধান-সম্মত নয়।”
তিনি বলেন, এরকম কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে সেটা “যথাযথ হবে না” এবং সেটা হবে “অশোভন।”
তবে রিপাবলিকান দল থেকে মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে ট্রাম্পের একজন প্রতিদ্বন্দ্বী ভিবেক রামস্বামী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ট্রাম্পকে ক্ষমা করে দেবেন।
তবে দলের ভেতরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রন ডিসান্টিস মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেছেন, ট্রাম্পের কারাগারে যাওয়া “দেশের জন্য শুভ হবে না।”