পাহাড়ে জমি কিনে ছদ্মবেশে থাকা জামাতুল আনসার ফীল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমিরকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাটি জানিয়েছে— ২০২১ সালে জঙ্গি সংগঠনটির আমির নির্বাচিত হন মো. আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ। সাবেক আমির মাইনুল ইসলাম রক্সিকে গ্রেফতারের পর দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। এরপর কুমিল্লা থেকে সম্পত্তি বিক্রি করে পাহাড়ে জমি কিনেন তিনি। ছদ্মবেশে থাকা শুরু করেন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে। পাহাড়ি সংগঠন কেএনএফের সঙ্গে শারক্বীয়ার সদস্যদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের চুক্তি করেন মাহমুদ। ওই সংগঠন থেকে অস্ত্র কেনা এবং প্রশিক্ষণের সুবিধার্থে পাহাড়ে অবস্থান নেন শারক্বীয়ার আমির।
সোমবার (২৪ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি জানিয়েছেন, নিজেকে আড়াল করতে তেল পাম্পের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতে মাহমুদ। তবুও সুবিধা করতে না পারায় পাহাড়ে আশ্রয় নেন তিনি এবং তার সদস্যরা। এছাড়া কেএনএফের প্রধান নাথান বমের সঙ্গে মাহমুদের সব সময় যোগাযোগ হতো বলেও জানিয়েছেন র্যাবের এই কর্মকর্তা।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, মাহমুদের নির্দেশনায় নাথান বমকে রাজধানীর বাসাবোতে বাসাভাড়া করে দেওয়া হয়। কেএনএফ প্রধান সেই বাসায় পরিবারসহ মাঝে মধ্যে অবস্থান করতেন। তার নির্দেশে বিভিন্ন স্থানে আনসার হাউজ তৈরি এবং পরিচালিত হতো। এরপর সংগঠনে যোগ দেওয়া সদস্যদের পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণে নেওয়া হতো। প্রশিক্ষণে অসম্মত কিংবা পালানোর চেষ্টা করলে তাদের বন্দি করা হতো নিজস্ব জেলখানায়। এছাড়া প্রশিক্ষণরত সদস্যরা বিদ্রোহ করলে তাদের গুলি করে হত্যার নির্দেশ দিতেন মাহমুদ। শারক্বীয়ার নতুন আমিরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছেন র্যাবের মিডিয়া উইং পরিচালক।
আল মঈন জানান, মূলত মাহমুদে নেতৃত্বে সারাদেশে পরিচালিত হতো সংগঠনটি। কেএনএফ প্রধান নাথান বমের সঙ্গে চুক্তি করে শারক্বীয়ার সদস্যদের পাহাড়ে আশ্রয়, অস্ত্র, রশদ সরবরাহ এবং সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। র্যাবের অব্যাহত অভিযান টেরপেয়ে আমিরের নির্দেশে সমতলের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে যায় সংগঠনটির সদস্যরা।
তিনি জানান, র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর অভিযান শুরু হলে পাহাড় থেকেও পালিয়ে যান মাহমুদ। দেশের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে থাকেন। সংগঠনকে পুনর্গঠন করতে শূরা সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কেএনএফের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। টাঙ্গাইল, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনের পর মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে একটি বাসা ভাড়া নেয়। সেখানে সংগঠনের বেশ কিছু সদস্য নিয়মিত আসা-যাওয়া করতো। নিরাপত্তার জন্য তিনি সবসময় তার সাথে ২ জন সশস্ত্র দেহরক্ষী রাখতেন।
র্যাবের মিডিয়া পরিচালক জানান, মাহমুদের সাথে আনসার আল ইসলামের নেতাদের সুসর্ম্পক ছিল। শীর্ষ জঙ্গি মেজর জিয়ার সাথে তার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল। ২০২২ সালে কিশোরগঞ্জে একটি মিটিংয়ে মাহমুদের সাথে আনসার আল ইসলামের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সে সময় আনসার আল ইসলাম মাহমুদকে ১৫ লাখ টাকা দেয়। পরে আরও টাকা দেওয়ার কথা ছিল। চুক্তি অনুযায়ী জামাতুল আনসারের সদস্যদের আনসার আল ইসলাম আইটি ও নিরাপত্তাবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেবে। বিনিময়ে আনসার আল ইসলামের সদস্যদের জামাতুল আনসার পার্বত্য অঞ্চলে অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করবে।
মাহমুদ যেভাবে জঙ্গি সংগঠনে এলেন
মাহমুদ ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র আমির। তিনি মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। এরপর কুমিল্লা সদর দক্ষিণের একটি সিএনজি রিফুয়েলিং পাম্পে ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করতেন। ইতোপূর্বে হুজির সদস্য ছিলেন। পরে তার সাথে কুমিল্লার একটি রেস্টুরেন্টে আনসার আল ইসলামের রক্সি ও ফেলানীর সাথে পরিচয় হয়। এরপর তারা যাত্রাবাড়িতে মিটিং করে নতুন একটি সংগঠন তৈরি ও বিস্তারের পরিকল্পনা করে শারক্বীয়ার কার্যক্রম শুরু করে। তিনি কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
২০১৬ সালের পর বিভিন্ন সময় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। ২০২০ সালে বান্দরবানের গহীন এলাকায় প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে গমন করেন। বান্দরবানে আসলাম নামে এক ব্যক্তির কাছে প্রায় ১ মাস সামরিক বিভিন্ন কৌশল, অস্ত্র চালনা, প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নেন। কুমিল্লার প্রতাপপুরে তার বাড়িসহ জমি এক ব্যক্তির কাছে ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন। সেই টাকার কিছু অংশ তিনি সংগঠনে দেন। অবশিষ্ট টাকা দিয়ে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে সাড়ে ৩ বিঘা জমি ক্রয় করে ওই বছরই সেখানে পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। পরে পোল্ট্রি ফার্ম, চাষাবাদ ও গবাদি পশুর খামার পরিচালনা করতেন।