বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে সারাবিশ্ব। আগামী ২০ বছরের মধ্যে চাহিদার ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সম্পদশালী দেশগুলো। বাংলাদেশেও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। সে লক্ষ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে ‘ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপ ২০২১-২০৪১’। ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ ভাগ ক্লিন এনার্জি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়াও ২০৩০ সালে সোলার থেকে ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কথা বলা হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির পরিধি যে গতিতে এগোচ্ছে তা অনেকটাই হতাশাজনক।
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশে নাবায়নযোগ্য জ্বালানির মূল হচ্ছে, পানি বিদ্যুৎ, সোলার পিভি ব্যবহার করে সৌর বিদ্যুৎ, বায়ু বিদ্যুৎ, পৌর বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ, গোবর এবং পোল্ট্রি বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োগ্যাস, বাতাসের গতি, ধানের তুস এবং ইক্ষুর ছোবড়া, বর্জ্য, শিল্প প্রক্রিয়ার অব্যবহৃত তাপ থেকে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি উৎপাদন। নবায়নযোগ্য এসব জ্বালানি উৎসের মধ্যে সৌর শক্তি সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এবং বায়োগ্যাস ও বায়োমাসের রয়েছে সীমিত ব্যবহার। দেশে প্রতিদিন গড়ে ৪.৫ কিলোওয়াট আওয়ার/বর্গমিটার সৌর বিকিরণ লাভ করে। তবে বায়ু বিদ্যুতের জন্য সম্ভাবনা এখানো গবেষণাধীন। বর্তমানে ১৩টি স্থান থেকে বাতাসের উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে।
স্রেডার সর্বশেষ তথ্যমতে বর্তমানে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১ হাজার ১৯৪ দশমিক ০১ মেগাওয়াট। এরমধ্যে অন গ্রিডে রয়েছে ৮২৫ দশমিক ২৪ মেগাওয়াট। এর প্রায় অধিকাংশ অংশই আসে সোলার থেকে ৯৬০ মেগাওয়াট। বাকি চার সেক্টর থেকে উৎপাদন হয় ৩৩৪ মেগাওয়াট। বর্তমানে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৮ হাজার ১৩৪ মেগাওয়াট। যা মোট উৎপাদনের ৪ দশমিক ২৪ শতাংশ। দেশে ২০২১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ যোগ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ থাকলেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, নিম্ন কার্বন নিঃসরণসহ টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য ব্যবহারকারী পর্যায়ে প্রাথমিক এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের জ্বালানি ব্যবহার এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে জ্বালানি দক্ষতা ও সংরক্ষণ মহাপরিকল্পনা ২০৩০ সালের মধ্যে ১৫ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয় করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ ভাগ ক্লিন এনার্জি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০৩০ সালে সোলার থেকে ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। বর্তমানে বায়ুবিদ্যুৎ, বর্জ্যবিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎসহ অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কার্যক্রম চলছে। নবায়নযোগ্য উৎস হতে ১ হাজার ১৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও ৮২৫ দশমিক ২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্রিডে আসে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি হতে ৩০টি প্রকল্পের মাধ্যমে আরও ১ হাজার ২৬২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প চলমান এবং ৮ হাজার ৬৬৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন। অর্থাৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি হতে ৯ হাজার ৯৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন পাইপ লাইনে আছে। আমরা নাবায়নযোগ্য উৎস হতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্রতিবেশী দেশ হতে আমদানি করার প্রক্রিয়াতেও আছি।
তিনি আরও জানান, নবায়নযোগ্য জ্বালানি আমাদের জন্য ব্যয়বহুল। আমাদের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এবং উর্বর ভূমি বড় চ্যালেঞ্জ। অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। আমাদের নেট মিটারিং ফর্মুলা গ্রাহকদের জন্য খুবই আকর্ষণীয়। আমি বলি, আপনি বাসায় সোলার প্যানেল নিয়ে যান। প্যানেল বসিয়ে বাড়তি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ দিন। স্রেডাতে আসুন তারা ফ্রি সহায়তা দিতে প্রস্তুত রয়েছে। যারা নেট মিটারিং ব্যবহার করছে, তাদের বিদ্যুৎ বিল অনেক কমে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে গতিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির তৎপরতা দেখা যাচ্ছে তাতে কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যে লক্ষমাত্রা অর্জন করা সম্ভব না। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০০৮ মতে ২০২১ সালে বিদ্যুতের ১০ শতাংশ হতে হতো নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ। বাস্তবে এক শতাংশও হয়নি। সৌরবিদ্যুৎ এখন ১০ টাকা ব্যয় হারেই উৎপাদন সম্ভব। অথচ আমদানিকৃত কয়লায় বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় হার গড়ে ১৭-১৮ টাকা। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় আরও বেশি। বিদ্যুৎ ওলিগোপলির শিকার না হলে বিদ্যুৎ ও ডলার সংকট সমাধানে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ হতো গুরুত্বপূর্ণ।
সংগঠনটি আরও বলছে, পরিকল্পনায় বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ এখনও ১০ শতাংশে আটকে আছে। ২০১৬ সালে বিদ্যুৎ খাত মহাপরিকল্পনা সংশোধনীতে ধরা হয় ২০২০, ২০৩০ এবং ২০৪১ সালের প্রতি ক্ষেত্রেই নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ১০ শতাংশ। প্রতিবছর জাতিসংঘ বিশ্ব জলাবায়ু সম্মেলন করে। ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত মতে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত হবে। সে লক্ষ্যে, দেশে দেশে জ্বালানি সংরক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন এবং পরিবহন, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ও আবাসিকে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রিড বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানি নবায়নযোগ্য জ্বালানি দ্বারা দ্রুত প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। প্রথাগত জ্বালানিতন্ত্র দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে। দেশে জন্ম নিচ্ছে কার্বনমুক্ত নতুন জ্বালানিতন্ত্র।
ক্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ২০০৯-২০১০ সালের দিকে সরকার তো বলেছিল, ২১ সালের মধ্যেই সরকার ১০ পার্সেন্ট অর্জন করবে। এখন তো ২০২৩ সাল। অর্জন করতে হবে বিদ্যুতে, ক্ষমতায় না। শুধু মুখে বললে তো হবে না। কাজে বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের কারিগরি যোগ্যতাও থাকা লাগবে। স্কিল ডেভলপড করতে হবে। প্রফেশনাল লোকজন তৈরি হতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সোলার সিস্টেমে যাওয়ার জমি নাই। এসব কোনো যৌক্তিক কথা না। আমাদের জমি কম, তাই বলে আমাদের কি খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে না? যেসব জায়গা ব্যবহার করার সেগুলো কি আমরা ব্যবহার করতে পেরেছি? বহু জায়গা ব্যবহার করার সুযোগ আছে, সেগুলো ব্যবহার করে দেখিয়ে বলতে হবে আর পারছি না, তখন আলাদা হিসাব। কিছু না করে জায়গা নেই বলে ধুয়ো তোলা এক ধরনের অজ্ঞতার পরিচয়।
এ বিষয়ে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের অবজারভেশন অনুযায়ী নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ২ শতাংশেরও নিচে। আমাদের রিসার্চ অনুযায়ী সেটা ১ দশমিক ৯৩ পার্সেন্ট। ধরেই নিলাম সরকারের হিসাব অনুযায়ী যদি চার পার্সেন্টও হয়, আমাদের ২০৪০ সাল নাগাদ যে ৪০ পার্সেন্টের উপর নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের কথা বলা হচ্ছে, বর্তমানে যে রেশিওতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যাচ্ছি, এটা খুব চ্যালেঞ্জিং। বলা যায় যে প্রায় অসম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে ১০০ পার্সেন্ট নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা চাইলে তা করতে পারি। এখন দরকার সদিচ্ছা এবং আমাদের যে সুযোগ সুবিধাগুলো আছে সেগুলো কাজে লাগানো।