করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে বিপর্যস্ত দেশের স্বাস্থ্য খাত দুর্নীতি ও অনিয়মের কলঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না, বরং নিত্যনতুন কেলেঙ্কারি প্রকাশ পাচ্ছে। সর্বশেষ ঢাকায় করোনা চিকিৎসায় বিশেষায়িত হিসেবে বিবেচিত ৯টি হাসপাতালে কেনাকাটায় অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেছে খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা বিভাগ। এই ৯টি হাসপাতালে ৯৫ খাতে কেনাকাটায় ৩৭৫ কোটি টাকার অনিয়ম পাওয়া গেছে। ২০ ধরনের অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কয়েক গুণ বেশি দামে ওষুধ-সরঞ্জাম কেনা, ৩৫০ টাকার কম্বল দুই হাজার ৪১৮ টাকায় কেনা, ওষুধ-সরঞ্জাম বুঝে না পেয়েই বিল পরিশোধ, ব্যবহারের অযোগ্য পণ্যও কেনা, একই মালিকানার তিন প্রতিষ্ঠানকে দরপত্রে অংশ নেওয়ার জন্য বাছাই করা, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া এবং প্রয়োজন ছাড়াও কেনাকাটা করা ইত্যাদি। গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে ১১ সদস্যের একটি দল এই নিরীক্ষা কার্যক্রম চালায়।
হাসপাতালগুলো হচ্ছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। তবে সব হাসপাতালেই ৯৫টি খাতের সব অনিয়ম ঘটেনি, কমবেশি হয়েছে।
কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ কয়েকটি হাসপাতালে কেনাকাটার সময় নিয়ম অনুযায়ী ১০ শতাংশ হারে জামানত না রেখেই কার্যাদেশ ও বিল দিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে একটি ব্যয়বহুল এক্স-রে মেশিন বুঝে না পেয়েই দুই কোটি ৮০ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে কিছু রি-এজেন্ট এবং ডেঙ্গু ডিভাইস বুঝে পাওয়ার আগেই বিল পরিশোধ করার ঘটনা ঘটেছে। সব হাসপাতালেই মেরোপেনেম ইনজেকশন কেনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম হয়েছে। কোনো কোনো হাসপাতাল বাজারমূল্যের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মূল্যে এই ইনজেকশন কিনেছে।
অন্যদিকে সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইডিসিএল প্রয়োজনীয় মুহূর্তে উৎপাদন বন্ধ রেখে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে উচ্চমূল্যে সরকারি হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহের সুযোগ করে দিয়েছে। এ ছাড়া কোনো কোনো হাসপাতালে চিকিৎসার যন্ত্রপাতি কেনার পর অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রেখে সরকারের কোটি কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি করেছে। ঠিকাদার চুক্তি অনুযায়ী সময়মতো মালপত্র বুঝিয়ে না দিলেও কার্যাদেশ বাতিল না করে তাদের বিল পরিশোধ করা হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও ইডিসিএলের উৎপাদিত চিকিৎসাসামগ্রীর মূল্য কম হওয়া সত্ত্বেও ওই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রয়োজনীয় উপকরণ না কিনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে কেনার ফলে সরকারের বিপুল অঙ্কের টাকা ক্ষতি হয়েছে। ব্যবহার অনুপযোগী এক্স-রে ফিল্ম কিনে সরকারের কয়েক কোটি টাকা ক্ষতি করা হয়েছে।
নিরীক্ষা দল জেনেছে, হাসপাতালগুলো কেনাকাটায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী ভ্যাট কাটেনি বা কম কাটা হয়েছে। প্রকৃত বাজারমূল্যের চেয়ে উচ্চমূল্যে পথ্য সরবরাহ করে অতিরিক্ত পরিশোধ, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও এমএসআর সামগ্রী বা যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে, দরপত্র আহ্বান ছাড়াই যন্ত্রপাতি কেনা ও মেরামত, চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে এমএসআর সামগ্রী কেনা হয়েছে, স্টোরে মালামাল পাওয়া যায়নি বা কম পাওয়া গেছে, পিপিআর ২০০৬ ও পিপিআর ২০০৮ অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়নি। আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ-২০১৫-এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে মালপত্র কেনা, অনুমোদিত বার্ষিক পরিকল্পনা ছাড়া কাজ করা, সরকারি ইডিসিএল ও জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ওষুধ, স্যালাইন ও স্যালাইন সেট থাকা সত্ত্বেও স্থানীয়ভাবে ঠিকাদারের মাধ্যমে কেনাকাটা, এমএসআর সামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে অতিরিক্ত পরিমাণে ওষুধ ছাড়াও এমএসআর সামগ্রী কেনা হয়েছে।
কাজ শেষ না হতেই ঠিকাদারকে চূড়ান্ত বিল পরিশোধ, দেরিতে কাজ সম্পাদনের জন্য জরিমানা আদায় না করা, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও সিএমএসডি থেকে পাঠানো ভারী যন্ত্রপাতি গ্রহণ করে ফেলে রাখা, কার্য সম্পাদন জামানত না কেটেই কার্যাদেশ ও বিল পরিশোধ করা, চিকিৎসার যন্ত্রপাতি না পেয়েই বিল পরিশোধ করা, টিইসি কমিটির সুপারিশ বা প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশ অমান্য করে মালপত্র গ্রহণ করা, বাজারমূল্য যাচাই না করেই দাপ্তরিক প্রাক্কলন করা, চুক্তি না করেই কার্যাদেশ দেওয়া ও বিল পরিশোধ এবং দরপত্র দাখিলে সময় যোগসাজশ করে উচ্চমূল্য প্রস্তুত করে যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এমএসআর সামগ্রী কেনার দরপত্র আহ্বান করা হলে সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি, ওষুধ, লিনেন ও আসবাবসংক্রান্ত দরপত্রের বিপরীতে প্রাপ্ত (সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি ও ওষুধের চারটি গ্রুপ, লিনেন তিনটি এবং আসবাবের পাঁচটি গ্রুপ) দরপত্রগুলোর মধ্যে তিনটি দরপত্রকে বৈধ ঘোষণা করা হয়। বৈধ তিনটি দরপত্র দেওয়া প্রতিষ্ঠান মেসার্স অরবিট ট্রেডিং, মেসার্স গোল্ডেন ট্রেডিং ও ইউরো ট্রেডিং দাখিলকৃত তিনটি দরপত্র যাচাই করে দেখা যায়, সব কটিই একই হাতে লেখা। এ ছাড়া ওই তিন প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স, আয়কর সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্রের মালিকের পিতা ও মাতা একই। অফিস ও বাসার ঠিকানা একই। অর্থাৎ ওই তিনটি প্রতিষ্ঠান একই সূত্রে গাঁথা এবং তারা যোগসাজশ করে দরপত্র জমা দিয়েছে। এর মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা ইউরো ট্রেডিংয়ের একটি কম্বলের দাখিল করা দর দুই হাজার ৪১৮ টাকা দেখানো হয়েছে। বাজারদর যাচাই করে দেখা গেছে, ওই মানের কম্বলের সর্বোচ্চ বাজারমূল্য ৩৫০ টাকা। পক্ষান্তরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এর চেয়ে ভালো মানের কম্বল প্রতিটি ৪৩২ টাকায় কিনেছে। ডায়ালিসিসের জন্য ব্যবহার করা রেনাল কেয়ার ‘এ’ এবং রেনাল কেয়ার ‘বি’ ও ‘এফ’ ক্যাথেটার দ্বিগুণ থেকে পাঁচ গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে।
নিরীক্ষায় দেখা গেছে, একটি হাসপাতালে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চিকিৎসার যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরঞ্জামের জন্য আহ্বান করা দরপত্র এবং চুক্তি সম্পাদন বা সরবরাহ আদেশের বিপরীতে সরবরাহ কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে, কিন্তু এই কাজের বিল পরিশোধ করা হয়েছে চলতি অর্থবছরে। এই বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি, যা নিতে হতো। আবার কেমিক্যাল রি-এজেন্ট সরবরাহের ক্ষেত্রে লেক্সিকন মার্চেন্ডাইজ বরাবর চুক্তি সম্পাদনের নোটিশ জারি করা হয়, কিন্তু তাদের সঙ্গে কোনো চুক্তি না করেই সরবরাহ আদেশ ও বিল দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ওই হাসপাতাল মালপত্র গ্রহণ না করে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করেছে বলেও প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও অডিট অনুবিভাগের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ শাহাদৎ হোসেন বলেন, যেকোনো অডিটে যদি কারো বিষয়ে গুরুতর সরকারি অনিয়ম ও আইন ভঙ্গের বিষয় উঠে আসে তবে অডিট টিমের সুপারিশ অনুযায়ী প্রশাসনিক বিভাগ থেকে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি ফৌজদারি বিধি অনুযায়ীও ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এ ছাড়া সাধারণত বিভাগীয় অনুসন্ধান ও মামলা হয়ে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আপত্তিকৃত অর্থ ফিরিয়ে নেওয়া কিংবা তাদের বেতন এমনকি পেনশনের টাকা থেকে তা আদায় করা হয়।
অডিট বিভাগ সূত্র থেকে জানা যায়, ঢাকার এই ৯টি হাসপাতালে অডিট হয়েছে গত বছরের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এবং প্রতিবেদন তৈরি করা হয় নভেম্বর থেকে। পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষ করে প্রতিবেদন সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানো হয়।