১৯৯৫ সালের বসনিয়ান সার্ব বাহিনী পূর্বাঞ্চলীয় শহর স্রেব্রেনিকায় আক্রমণ করে ৮হাজারের বেশি বসনিয়ান মুসলিম পুরুষ এবং ছেলেদের হত্যা করেছিল। ১১ জুলাই ২০২৩ ছিল স্রেব্রেনিকা গণহত্যার ২৮তম বার্ষিকী। এ উপলক্ষে শহিদদের স্মরণে নানা কর্মসূচি পালন করছে সেখানকার মুসলিমরা।
স্রেব্রেনিকা গণহত্যা ঘটেছিল ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে, বলকান গৃহযুদ্ধের সময়। বসনিয়ার সার্ব সৈন্যরা যখন জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী কর্তৃক নিরাপদ এলাকা বলে ঘোষণা করা স্রেব্রেনিকা শহর এবং তার আশপাশের এলাকা দখল করে নেয়, তখনই ঘটেছিল ভয়াবহ এই গণহত্যা।
১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী ১১ দিন ধরে চলা স্রেব্রেনিকা গণহত্যায় প্রাণ হারায় প্রায় ৮,০০০ বসনিয়ান মুসলিম, যাদের সিংহভাগই ছিল অল্প বয়সী ছেলে, কিশোর ও পুরুষ। নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞের বিভীষিকায় স্তম্ভিত হয়ে ওঠে পুরো বিশ্ববাসী।
সেখানে জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী হিসেবে মোতায়েন ছিলেন এমনি একজন ডাচ সেনা ভিম ডাইকেনার। কয়েক বছর আগে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিবিসি।
১৯৯০ এর দশকের শুরুতে বলকান যুদ্ধ যখন শুরু হলো, তখন একটানা তিন বছর আট মাস ধরে বসনিয়ার সারায়েভো ছিল এক অবরুদ্ধ শহর। শহরটি ছিল প্রধানত বসনিয়াক মুসলিম অধ্যূষিত। চারপাশের পাহাড়ের আড়াল থেকে যখন সার্বিয়ান বন্দুকধারীরা গোলাগুলি শুরু করলো, শহরের মুসলিম বাসিন্দারা তখন নিজেদের শহরেই জিম্মি হয়ে পড়লেন।
সারায়েভো ধেকে ৮০ কিলোমিটার দূরের শহর স্রেব্রেনিকা ভিম ডাইকেনার এসেছিলেন ১৯৯৫ সালের জানুয়ারিতে ।তিনি ছিলেন জাতিসঙ্ঘের ৬ হাজার হালকা অস্ত্রসজ্জিত শান্তিরক্ষী সেনাদের একজন। ওই স্রেব্রেনিকা এলাকার হাজার হাজার বেসামরিক লোকের সাথে মুসলিম যোদ্ধারাও ছিল।
আর ওই এলাকাটি ঘিরে ছিল বসনিয়ান সার্ব বাহিনী- যাদের নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল রাটকো ম্লাদিচ। সার্ব বাহিনীর সাথে অস্ত্রের শক্তিতে ডাচ শান্তিরক্ষীদের কোনভাবেই পেরে ওঠা সম্ভব ছিল না।
জুলাই মাসের প্রথম দিকে ডাচ সৈন্যদেরকে তাদের নিয়ন্ত্রিত একটা ফাঁড়ি থেকে পিছিয়ে আসতে হলো। কিন্তু এর ফলে মুসলিম যোদ্ধারা শান্তিরক্ষীদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তাদের একজন শান্তিরক্ষীদের ওপর গ্রেনেড ছুঁড়লো, তাতে একজন ডাচ নিহত হলো।
এর কিছু পরই ৩০ জন ডাচ শান্তিরক্ষী সার্বদের কাছে আত্মসমর্পণ করলো এবং তাদের জিম্মি করা হলো। জুলাই মাসের ১১ তারিখে ডাচ শান্তিরক্ষীরা সার্ব অবস্থানগুলোর ওপর ব্যাপক বিমান আক্রমণ চালানোর জন্য ন্যাটোকে অনুরোধ জানালো।
বিকেল বেলা দুটি বিমান এলো, কিন্তু তারা মাত্র দুটি বোমা ফেললো। তখন সার্বরা তাদের হাতে থাকা ডাচ জিম্মিদের হত্যা করার হুমকি দিলো এবং এরপর আর বিমান আক্রমণ চালানো হলো না।
এর কয়েক ঘন্টা পরই সার্ব বাহিনীর হাতে স্রেব্রেনিকার পতনের খবর বিশ্ববাসী জানতে পারে। তারপর শুরু হলো গণহত্যা। বসনিয়ান সার্বরা মুসলিম পুরুষ ও বালকদের ধরে নিয়ে যেতে শুরু করলো। মোট ৮ হাজার লোককে হত্যা করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে এত বড় গণহত্যা আর হয়নি। তবে বসনিয়ার যুদ্ধে ছিল আরও একটি পক্ষ, এই ত্রিমুখী লড়াইয়ে সার্বিয়ান এবং মুসলিমরা ছাড়াও জড়িয়ে পড়েছিল ক্রোয়েশিয়ানরাও।
১৯৯৫ সালে স্রেব্রেনিকায় আট হাজার মুসলিমকে হত্যা করা ছিল সেই যুদ্ধের সবচেয়ে নারকীয় হত্যাকান্ড। মুসলিম পুরুষ এবং বালকদের বেছে বেছে আলাদা করে হত্যা করা হয়, তারপর তাদের গণকবর দেয়া হয়।
জেনারেল রাটকো ম্লাদিচের নেতৃত্বে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যেখানে এই অভিযান চালানো হয়, সেটি ছিল জাতিসংঘের ঘোষিত নিরাপদ অঞ্চল।
পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ম্লাদিচের বিচারের সময় কৌঁসুলিরা বলেন, বসনিয়া থেকে বসনিয়ান মুসলিমদের জাতিগতভাবে নির্মূল করার যে ঘৃণ্য পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল, সার্ব বাহিনী ভিআরএস এর অধিনায়ক হওয়ার মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়েছিলেন জেনারেল ম্লাদিচ।
সেদিন থেকে এই গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধের সঙ্গে তিনি সরাসরি সংশ্লিষ্ট হন। কৌঁসুলিরা আরও বলেন, জেনারেল ম্লাদিচ এবং তার বাহিনী স্রেব্রেনিকায় হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। ম্লাদিচকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় এবং তিনি এখনো সাজা ভোগ করছেন।
বলকান যুদ্ধের গণহত্যার এবং অন্যান্য যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে এর আগে সাবেক সার্বিয়ান প্রেসিডেন্ট স্লোবোডান মিলোসেভিচকেও বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৬ সালে বিচার শেষ হওয়ার আগেই তিনি কারাবন্দী অবস্থায় মারা যান।
অপর এক সার্ব রাজনৈতিক নেতা রাদোভান কারাদিচকেও ২০০৮ সালে গ্রেফতার করা হয়। একই অভিযোগে তারও বিচারের পর কারাদণ্ড হয় দ্য হেগের আদালতে।
সূত্র: বিবিসি ও রোর মিডিয়া