কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, চাহিদা-সরবরাহের ফারাক, আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য অথবা মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি, কোনো ব্যাখ্যাই সাধারণ মানুষের কাছে প্রাসঙ্গিক নয়। তারা মূল্যবৃদ্ধিতে কষ্টে আছে। তাদের জীবনমানের অবক্ষয় হচ্ছে। তারা মনে করে- সরকারের ব্যর্থতার কারণে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে।
মঙ্গলবার (১১ জুলাই) দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও করণীয় শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন, আপাত দৃষ্টিতে বাজারে সরবরাহে ঘাটতি নেই। তা সত্ত্বেও দেশে উৎপাদিত এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের মূল্য হুহু করে বাড়ছে। অধিকাংশ পণ্যের মূল্য এখন সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে এবং ধার-কর্জ করে অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করছে। অনেক চাহিদাই পূরণ সম্ভব হচ্ছে না। জীবনমানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ক্যাব সভাপতি বলেন, বিগত বছরের বাজেটে মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে নির্ধারণ করা হয় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের কয়েক দিনের মধ্যে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৯ দমিক ০২ শতাংশ, যা বিগত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার দর পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গত এক বছরে অনেক পণ্যেরই মূল্যবৃদ্ধি ছিল অনেক বেশি। অনেকে মনে করেন সাধারণ মানুষের জীবনে মুদ্রাস্ফীতির আঁচ পড়ছে না।
পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সরকারের ধারণা, করোনাভাইরাস মহামারি পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে সরবরাহ সংকট, বর্ধিত চাহিদা, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে পণ্যমূল্য বেড়েছে। আর সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ। অর্থনীতিবিদদের অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ গ্রহণের ফলে মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছে, যা মুদ্রাস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে আমদানি ব্যাহত হচ্ছে, সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হচ্ছে এবং মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশ্ব বাজারে অনেক পণ্যেরই মূল্য কমে এসেছে জানিয়ে গোলাম রহমান বলেন, বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় স্ব স্ব ভোক্তাদের মুদ্রাস্ফীতি থেকে রক্ষায় মুদ্রা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বারবার সুদের হার বৃদ্ধি এবং অর্থ মন্ত্রণালয় মুদ্রাস্ফীতি নিরোধক আর্থিক ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্ব স্ব দেশে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রতিবেশী ভারতে গত এপ্রিলে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৪ দশমিক ৭ শতাংশ, যা অক্টোবর ২০২১ এরপর সর্বনিম্ন। মে মাসে ইউরো জোনে মুদ্রাস্ফীতি ৬ দশমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছে, যা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সবচেয়ে কম। এপ্রিলে কানাডা, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় মুদ্রাস্ফীতি ছিল। যথাক্রমে ৪ দশমিক ৩, ৪ দশমিক ৩ এবং ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। চীনে মে মাসে মূল্যবৃদ্ধি ছিল মাত্র ০ দশমি ২ শতাংশ, যা দুই বছরে সর্বনিম্ন, আর ভিয়েতনামে ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ, বিগত ১৪ মাসে সবচেয়ে কম। এপ্রিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি ৫ দশমিক ০ শতাংশে নেমে এসেছে। স্পষ্টতই, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দেশে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত হিসাবে দেখানো, বড়জোর খোঁড়া যুক্তি।
করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, মূল্য পরিস্থিতি এক দিনে বর্তমান পর্যায়ে আসেনি, তাৎক্ষণিকভাবে তা নিয়ন্ত্রণও সম্ভব নয়। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত মুদ্রা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা অত্যাবশ্যক, তবে তা পর্যাপ্ত নাও হতে পারে। অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীলতা কম। সরবরাহ সামান্য হ্রাস পেলে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি পায়। ১৯৯১ সাল থেকে অনিয়ন্ত্রিত ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ অনুসরণের ফলে দেশে গুটিকতক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান প্রায় প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা অর্জন করেছে। ধারণা করা হয়, বাজারে প্রতিযোগিতা না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠান পণ্যের সরবরাহ ও মূল্য নির্ধারণ করে অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জন করছে।
তিনি জানান, পণ্যমূল্য একবার বৃদ্ধি পেলে তা আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের সময় অথবা গত শতাব্দীতে পরবর্তী সময়ে মূল্য পরিস্থিতি যেমন ছিল তা আবার আশা করা অবাস্তব। সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান বাড়লে, আয়-রোজগার মূল্যস্ফীতির চেয়ে অধিক হারে বাড়লে, তাদের জীবন মানের উন্নতি হয়, কল্যাণ বাড়ে। মুদ্রাস্ফীতির আঁচ সহ্য করা সহজ হয়।
সাধারণ মানুষের আয়-রোজগার বৃদ্ধি, তাদের কল্যাণ ও জীবন মানের উৎকর্ষ সাধন এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে লাগসই নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হলেই কেবল ঊর্ধ্বমুখী মূল্য পরিস্থিতির লাগাম টেনে জন-জীবনে স্বস্তি ও শান্তি আনা সম্ভব হতে পারে। বাজারের আগুনের আঁচ তাতে কিছুটা হলেও সহনীয় হবে বলেও তিনি বক্তব্যে তুলে ধরেন।
এ সময় ক্যাবের নেতারা বক্তব্য রাখেন। তারা সকলে দেশের জনগনকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ক্যাবের সঙ্গে এক যোগে কাজ করার আহ্বান জানান।