দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে নতুন করে একটি সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ সাগরটির সীমানা নিয়ে বিভিন্ন দেশ বিরোধে লিপ্ত ছিল বহু শত বছর ধরে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই সীমানা বিরোধ নিয়ে উত্তেজনা অনেক বেড়েছে।
বিশেষ করে এ সাগরের মালিকানা নিয়ে সম্প্রতি চীন যে ধরনের ব্যাপক দাবি শুরু করেছে, যার মধ্যে বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জ এবং সংলগ্ন সমুদ্রসীমাও রয়েছে, তা ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া ও ব্রুনেইকে ক্ষুব্ধ করেছে। এসব দেশও এখন দক্ষিণ চীন সাগরের সীমানা নিয়ে পাল্টা দাবি করছে।
অন্যান্য দেশও সাগরের মাঝখানে অবস্থিত প্যারাসেল ও স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ এবং সাগরের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর তাদের অধিকার দাবি করছে।
চীন তাদের দাবির সমর্থনে সাগরের মাঝখানে অনেক কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করছে এবং নৌবাহিনী পাঠিয়ে টহল দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা সীমানা বিরোধে কোনো পক্ষ নেয় না, কিন্তু সেখানে যুদ্ধজাহাজ আর যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছে, যেটিকে তারা “নৌপথে চলাচলের স্বাধীনতা” রক্ষার অভিযান বলে বর্ণনা করে থাকে।
দক্ষিণ চীন সাগরে জাপানের কোনো সরাসরি দাবি নেই। তবে তারা সেখানে ভিয়েতনাম ও ফিলিপিন্স-এর দাবির সমর্থনে নিজেদের জাহাজ এবং সামরিক সরঞ্জাম পাঠায়।
এই অঞ্চলে একটা সংঘাত বেধে যেতে পারে বলে আশংকা তৈরি হয়েছে। যদি এরকম সংঘাত শুরু হয়, তবে তার প্রভাব পড়বে পুরো বিশ্বে।
এই সমুদ্র সীমা নিয়ে বিভিন্ন দেশের এত আগ্রহ কেন?
দক্ষিণ চীন সাগর একটি প্রধান সমুদ্র পথ। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আংকটাডের অনুমান, বিশ্বের মোট বাণিজ্যের প্রায় ২১ শতাংশ ২০১৬ সালে এই সমুদ্র পথে পরিবহন করা হয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ৩.৩৭ ট্রিলিয়ন ডলার।
এছাড়া এখানে মৎস্য সম্পদও আছে প্রচুর। পুরো অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ এই সাগরে মাছ ধরে জীবন চালায়। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মাছ ধরা জাহাজ ও নৌকা চলে এখানে।
প্যারাসেল ও স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ প্রায় মানব বসতিহীন। তবে এই দু’টি জায়গার আশে-পাশেই হয়তো প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ আছে। এসব এলাকায় কোন বিস্তারিত অনুসন্ধান বা জরিপ এখনও হয়নি। কাজেই নিকটবর্তী অন্যান্য অঞ্চলে পাওয়া খনিজ সম্পদের ভিত্তিতেই এই এলাকার সম্পদের অনুমান করা হচ্ছে।
নাইন-ড্যাশ লাইন ও অন্যান্য দাবি
দক্ষিণ চীন সাগরের সবচেয়ে বড় অংশটি দাবি করে চীন। তথাকথিত নাইন-ড্যাশ লাইনের মাধ্যমে চীন তাদের এই সীমানা চিহ্নিত করে রেখেছে। মোট ৯টি ড্যাশ চিহ্ন দিয়ে এই নাইন-ড্যাশ লাইনটি তৈরি। এটা চীনের সবচেয়ে দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ হাইনান থেকে শত শত মাইল দক্ষিণ এবং পূর্বদিক পর্যন্ত বিস্তৃত।
চীন ১৯৪৭ সালে একটি মানচিত্র প্রকাশ করে এতে তাদের দাবির বিস্তারিত তুলে ধরেছিল। তারা বলেছিল, তাদের এই দাবির সমর্থন মিলবে ইতিহাসে। বেইজিং বলছে, তাদের এই দাবি বহু শত বছরের পুরনো, যখন প্যারাসেল ও স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ চীনা জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে গণ্য হতো।
তবে ঠিক এই একই দাবি করে তাইওয়ান।
তবে সমালোচকরা বলেন, চীন আসলে সুনির্দিষ্টভাবে বলে না তাদের দাবিতে কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত। আর চীনের আঁকা মানচিত্রে যে নাইন-ড্যাশ লাইন দেখা যায়, সেটি প্রায় পুরো দক্ষিণ চীন সাগরজুড়ে বিস্তৃত, এর কোনো বিন্দু থেকে কতটুকু পর্যন্ত তাদের সীমানা সেটির উল্লেখ নেই।
আর চীন এই নাইন-ড্যাশ লাইনের মধ্যে যেসব স্থলভূমি, কেবল সেগুলোই দাবি করছে নাকি এর সঙ্গে পুরো সমুদ্র-সীমার ওপরও দাবি জানাচ্ছে, তা পরিষ্কার নয়।
ভিয়েতনাম চীনের এসব দাবির সঙ্গে তীব্র দ্বিমত পোষণ করে। তারা বলে, ১৯৪০ এর দশকের আগে চীন কখনই এসব দ্বীপের ওপর সার্বভৌমত্বের দাবি জানায়নি। ভিয়েতনাম দাবি করে, প্যারাসেল ও স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ তারাই শাসন করেছে ১৭শ শতক থেকে এবং তাদের কাছে এর দালিলিক প্রমাণ আছে।
ফিলিপাইন্সও এই অঞ্চলের ওপর দাবি জানায়। এক্ষেত্রে স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ ভৌগোলিকভাবে তাদের দেশের কতটা কাছাকাছি সেটি তারা উল্লেখ করে।
অন্যদিকে স্কারবারা দ্বীপের ওপর দাবি জানায় চীন এবং ফিলিপিন্স উভয় দেশই (চীনে স্কারবারা দ্বীপ হুয়াংগিয়ান নামে পরিচিত)। এই দ্বীপের অবস্থান ফিলিপিন্স থেকে এক শ’ মাইল, অন্যদিকে চীন থেকে পাঁচ শ’ মাইল দূরে।
মালয়েশিয়া এবং ব্রুনেইও দক্ষিণ চীন সাগরের কিছু অংশের ওপর দাবি জানায়। তারা বলে, জাতিসংঘের সমুদ্র-সীমা সংক্রান্ত সনদে (ইউনাইটেড নেশন্স কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্যা সী বা আনক্লস) ইকনমিক এক্সক্লুশন জোনের যে সংজ্ঞা দেওয়া আছে, সেই অনুযায়ী এগুলো তাদের সীমানা।
বিতর্কিত দ্বীপগুলোর ওপর ব্রুনেই কোনো দাবি জানায় না, তবে মালয়েশিয়া স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জের কিছু কিছু দ্বীপ নিজেদের বলে দাবি করে।
মারাত্মক সংঘাত
দক্ষিণ চীন সাগরে সীমানা বিরোধ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে গুরুতর গোলযোগ হয়েছে ভিয়েতনাম এবং চীনের মধ্যে। ফিলিপিন্স এবং চীনও কয়েকবার মুখোমুখি সংঘাতে জড়াবার উপক্রম হয়েছে। এরকম কিছু ঘটনাবলী:
(ক) ১৯৭৪ সালে চীনারা ভিয়েতনামের কাছ থেকে প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয়। এ সময় ৭০ জন ভিয়েতনামী সেনা নিহত হয়।
(খ) ১৯৮৮ সালে স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জে আবার দুই পক্ষ মুখোমুখি হয়। এবারও ভিয়েতনাম বেশি ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয়, তাদের ৬০ জন নাবিক মারা যায়।
(গ) ২০১২ সালের শুরুর দিকে চীন ও ফিলিপিন্স সাগরে দীর্ঘ সময় ধরে মুখোমুখি অবস্থানে ছিল, তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে স্কারবারা দ্বীপপুঞ্জে অনুপ্রবেশের অভিযোগ করছিল।
(ঘ) ২০১২ সালে এরকম একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে যে চীনা নৌবাহিনী ভিয়েতনামের একটি অনুসন্ধানী অভিযানে নাশকতা চালিয়েছে। এই খবর যাচাই করা যায়নি, তবে ওই সময় ভিয়েতনামের রাস্তায় অনেক বড় বড় চীনবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে।
(ঙ) ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ফিলিপিন্স জানায়, তারা দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের দাবিকে চ্যালেঞ্জ করতে জাতিসংঘের সমুদ্র-সীমা সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালে যাচ্ছে।
(চ) ২০১৪ সালের মে মাসে প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জের কাছে চীন একটি ড্রিলিং রিগ বসায়। একে কেন্দ্র করে ভিয়েতনামী ও চীনা জাহাজগুলোর মধ্যে কয়েক দফা সংঘাত হয়।
(ছ) ২০১৯ সালের জুন মাসে ফিলিপিন্স অভিযোগ করে যে একটি চীনা ট্রলার একটি ফিলিপিনো মাছ ধরা নৌকাকে ধাক্কা দিয়েছে, ওই নৌকায় ২২ জন আরোহী ছিল। ভিয়েতনামীরা এসে এই ফিলিপিনোদের উদ্ধার করে।
(জ) ২০২৩ সালের শুরুতে ফিলিপিন্স অভিযোগ করে যে চীনা জাহাজগুলো ফিলিপিনো নৌকাগুলোর দিক লেজার রশ্মি তাক করছে, যাতে নাবিকদের সাময়িকভাবে অন্ধ করে দেওয়া যায়। ফিলিপিন্স আরও অভিযোগ করে যে চীনারা তাদের জাহাজগুলো ফিলিপিনোদের জাহাজ বা নৌকার খুব বেশি কাছ দিয়ে বিপদজনকভাবে চালাচ্ছে এবং ফিলিপিনোদের চলার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।