বিএনপির আন্দোলন ও ঈদের মধ্যে একটা অদৃশ্য যোগসূত্র গড়ে উঠেছে। ২০১৪ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের আগে থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাশাপাশি দলটির অন্য শীর্ষ নেতারা ঈদের পরে আন্দোলনের হুঙ্কার দিয়েছেন বহুবার। এ নিয়ে অনেক তীর্যক মন্তব্যও শুনতে হয়েছে বিএনপিকে। এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কোরবানির ঈদের পর সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের চূড়ান্ত ঘোষণা দেওয়ার কথা জানিয়েছে দলটি। এ লক্ষ্যে রাজপথে কর্মসূচি নিয়ে ‘হার্ডলাইনে’ যাওয়ার ইঙ্গিতও দিচ্ছে বিএনপি।
একযুগের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি বলছে, সরকারের বিরুদ্ধে সরব দলগুলোকে নিয়ে ঈদের পর এক দফার কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে এবার সরকারকে বিদায় করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, চেয়ারপারসনের মুক্তিসহ দাবি আদায় করে ঘরে ফিরবেন তারা।
নিজেদের আন্দোলন ত্বরান্বিত করতে এবার সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে পাশে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পাচ্ছে বিএনপি। বিশেষ করে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে গণতন্ত্র মঞ্চ ও ১২ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে নিয়মিত বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে বোঝাপাড়া চলছে। যে কারণে এবার জোরদার আন্দোলন নিয়ে আশাবাদী দলটির নেতারা।
ঈদের পরে আন্দোলন আরও বেগবান হবে জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, যারা আমাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করছে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে আন্দোলন আরও বেগবান করা হবে।
তবে দলীয় সূত্র বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির কথা মাথায় রেখে আন্দোলন যাতে কোনোভাবে সহিংতার দিকে না যায় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে দলটির হাইকমান্ড।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঢাকা মেইলকে বলেন, সরকার আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে নানাভাবে চেষ্টা করছে। তাই এখনই কিছু বলা মুশকিল। তবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে দাবি আদায়ের যুগপৎ আন্দোলন এক দফা দাবিতে রূপ দেওয়া হবে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে কর্মসূচি চূড়ান্ত করব।
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে সমাবেশের মাধ্যমে ১০ দফা ঘোষণা করে বিএনপি। এর ভিত্তিতে গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় যুগপৎ আন্দোলন। ঈদুল ফিতরের আগ পর্যন্ত যুগপৎ সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোট নানা কর্মসূচি পালন করে। গণমিছিল, গণঅবস্থান, মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ, গণসমাবেশ, মানববন্ধন, পদযাত্রার মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করা হয়। তবে গত ঈদের পর থেকে বিএনপি এককভাবে কর্মসূচি পালন করছে।
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় অন্তর্বতীকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন এবং খালেদা জিয়াসহ জাতীয় নেতাদের মুক্তির দাবি নিয়ে ‘এক দফা’ কর্মসূচিতে নিয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। মাঝে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে যৌথ ইশতিহার চূড়ান্ত করা হবে। এই নিয়ে একাধিকবার অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেছে যুগপৎ আন্দোলনের অন্যতম শরিক গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা। শিগগিরই চূড়ান্ত বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
তবে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চ সূত্রে জানা গেছে, কাছাকাছি সময়ে আলাদা প্লাটফর্ম থেকেও ঘোষণা করা হতে পারে চূড়ান্ত ইশতেহার। কিছু বিষয় নিয়ে ঐক্যমতে পৌঁছাতে না পারায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা বিপ্লবী ওর্য়াকার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ঈদের পর জুলাই মাসে এক দফা আন্দোলনে চলে যাব। এর আগে যৌথ ইশহেতার ঘোষণা করা হবে।
ইশতেহারের মূল বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমান সংসদ ভেঙ্গে দেওয়াসহ সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন এবং খালেদা জিয়ারসহ জাতীয় নেতাদের মুক্তির দাবিগুলো সামনে রেখে এক দফা আন্দোলন চূড়ান্ত করা হবে।
এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সবার সঙ্গে আলোচনা করে নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা দেওয়া হবে। সোমবার (২৬ জুন) বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজেই সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়েছেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা এ সরকার নিয়ে আরও সুস্পষ্টভাবে কথা বলব। এজন্য আমরা সবার সঙ্গে আলোচনা করছি। দেশে যারা সংবিধান বিশেষজ্ঞ আছেন বা আইনজীবী আছেন, তারা তাদের মতো করে মতামত দেবেন। সেখান থেকে একটা ভালো জিনিস বের হয়ে আসবে।
জানা গেছে, ঈদুল আজহার পর জুলাই মাসের মাঝামাঝি আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে বিএনপি। এর আগে জুলাইয়ের ১০ তারিখের মধ্যে যৌথ ইশতেহার ঘোষণার সম্ভাবনা আছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার পর থেকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ভারত, চীন, রাশিয়ার কূটনীতির ওপর কড়া নজর রাখছে বিএনপির হাইকমান্ড। পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্যদিয়ে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিএনপির নেতারা মনে করেন, নতুন মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর সরকার চাপে আছে। এমন অবস্থায় বিরোধী দলকে রাস্তায় নামতে বাধা দিলে চাপ আরও বাড়বে। ফলে দাবি আদায়ে এক দফার চূড়ান্ত আন্দোলন নামার মোক্ষম সময় হিসেবে জুলাই মাসকে বেছে নিতে চায় দলটি। তবে কতদিন মাঠের কর্মসূচি টেনে নেওয়া যাবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে নেতাদের মধ্যে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক ঢাকা মেইলকে বলেন, কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার পর গতি ধরে না রাখতে পারলে ফলাফল পাওয়া কঠিন। এটাও চিন্তা করতে হবে। অতীতে লম্বা সময় ধরে কর্মসূচি দিয়ে শেষে খেই হারিয়ে ফেলতে হয়েছে। এবারও যেন এমনটা না হয়, তা আগেই ভাবতে হবে।
এদিকে আন্দোলনের মূল শক্তি হিসেবে কাজে লাগাতে দেশব্যাপী তরুণদের উদ্বুদ্ধ করার মিশনে নেমেছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে ঢাকাসহ দেশের ছয়টি বড় শহরে ১১ দফার ভিত্তিতে ‘তারুণ্যের সমাবেশ’ করছে করছে বিএনপির প্রধান তিন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। চট্টগ্রামে তারুণ্যের সমাবেশের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই কর্মসূচি ২২ জুলাই ঢাকায় সমাবেশের মধ্যদিয়ে শেষ হবে।
তারুণ্যের এই সমাবেশগুলো এখন পর্যন্ত অনেকটা সফল হওয়ায় বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি, এর মধ্যদিয়ে আশার আলো দেখতে পারছেন তারা।
বরিশালের সমাবেশে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত কেউ ঘরে ফিরব না—মর্মে উপস্থিত নেতাকর্মীদের শপথবাক্য পাঠ কারানো হয়। এসময় যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলেন, মরার জন্য প্রস্তুতদের কেউ মারতে পারে না। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউ ঘরে ফিরে যাব না।
সমাবেশের মধ্যদিয়ে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসানের। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, সারা দেশে নতুন করে তরুণ প্রজন্মের মাঝে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। ইনশাআল্লাহ তরুণ প্রজন্মের হাত ধরেই বর্তমান সরকারের পতন ঘটবে। আমরা সেই পথে হাঁটছি।