চেকে স্বাক্ষর না করায় প্রকৌশলীকে দুই ঘণ্টা আটকে রেখে রাখেন বাবুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুসরাত ফাতিমা। এসময়ে ইউএনও উপজেলা প্রকৌশলীকে গ্রেপ্তারের ঘোষণা দেন এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতে দণ্ড দেওয়ার হুমকি দেন বলে অভিযোগ করেছেন উপজেলা প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম।
রোববার (২৫ জুন) বিকেলে বাবুগঞ্জ উপজেলা সদরের সোনালী ব্যাংক খানপুরা শাখায় এ ঘটনা ঘটে। ইউএনও উপজেলা প্রকৌশলীকে ব্যাংকের মধ্যে অবরুদ্ধ করে রাখার সময় ব্যাংক লেনদেনে বিঘ্ন ঘটে বলে জানা যায়।
এ সময় সেবা প্রত্যাশীদের এসে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এদিন সাড়ে ৪টার কিছু সময় পর থেকে তাদের আটকে রাখা হয়। স্বাক্ষর দিলে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মুচলেকায় প্রকৌশলীকে বের হতে দেন। এরপর সোনালী ব্যাংকের শাখা থেকে ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ আওয়ামী লীগ নেতারা তড়িঘড়ি করে বের হয়ে যান। গণমাধ্যমকর্মীরা কথা বলতে চাইলে তারা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন।
উপজেলা প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম আজ সকালে মুঠোফোনে বলেন, এডিপি প্রকল্পের প্রায় দুই কোটি টাকা বরাদ্দ আসে। সেই টাকা উপজেলা চ্যেয়ারম্যান ও ইউএনও মহোদয় দুজনের যৌথ অ্যাকাউন্ট করে রাখার পরিকল্পনা করেন যেন পরবর্তীতে কাজ করিয়ে টাকা দিতে পারেন। আমরা সরকারি চাকরি করি। যেকোনো সময়ে আমি বা ইউএনও বদলি হয়ে যেতে পারি। তখন টাকাটি কাজ ছাড়াই বেহাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য আমি বলেছি যৌথ অ্যাকাউন্ট শুধু ইউএনও ও উপজেলা চেয়ারম্যান নয় আমাকেও যুক্ত করে করা হোক।
কিন্তু বিষয়টি উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনও মেনে না নিয়ে গতকাল বিকেলে আমাকে সোনালী ব্যাংক খানপুরা শাখায় দুই ঘণ্টা একটি কক্ষে আটকে রাখেন। এসময়ে ইউএনও আমাকে গ্রেপ্তারের হুমকি দেন। আনসার সদস্য দিয়ে আমাকে অপমান করান। আমিও একজন সরকারি কর্মকর্তা। কাজ শেষ না হওয়ায় নিয়ম ভেঙে আমাকে চাপ দিয়ে চেকে স্বাক্ষর করিয়ে তাদের অ্যাকাউন্টে নিয়ে রেখেছেন। আমি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। তারা তদন্ত করে দেখছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ২ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সোনালী ব্যাংকের ওই শাখায় একজন জনপ্রতিনধিসহ নুসরাত ফাতিমা উপজেলা প্রকৌশলীকে আটকের হুমকি দেন।
ইউএনও নুসরাত ফাতিমা তার সঙ্গে থাকা দুজনকে ডেকে বলেন, ‘অ্যাই সাইফুল, জাহিদ এদিকে আসো। যতক্ষণ না স্বাক্ষর করবে ততক্ষণ বের হবে না। এ্যারেস্টেড, সোল ডাউন।’
ওই ভিডিওতে বাবুগঞ্জ উপজেলা সদরের সোনালী ব্যাংকের ভেতরের চিত্র স্পষ্ট প্রকাশ পায়।
প্রত্যক্ষদর্শী উপজেলার কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী জানিয়েছেন, তারা খবর পেয়ে ব্যাংকের সামনে গেলেও ভেতর থেকে দরজা আটকানো থাকায় প্রবেশ করতে পারেনি। ভেতরে আটকা পরা একটি সাংবাদিক সংগঠনের নেতা বলেন, কাজ শেষ না হওয়া প্রকল্পের চেকে স্বাক্ষর না করায় উপজেলা প্রকৌশলীকে আটকে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হচ্ছিল। তিনি স্বীকার না করায় তাকে একটি কক্ষে নিয়ে আটকে রাখা হয়। এমনকি এসময়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনসারদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন, উপজেলা প্রকৌশলী গ্রেপ্তার। তাকে বের হতে দেবে না। এরপরে প্রকৌশলীকে ইউএনওর নির্দেশে একটি কক্ষে নিয়ে আটকে রাখা হয় এবং ব্যাংকের মধ্যে থাকা সেবা গ্রহীতাদের বাইরে বের করে দিয়ে ভেতর থেকে গেট আটকে দেওয়া হয়।
সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে উপজেলা প্রকৌশলী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ব্যাংকের শাখা থেকে বের হলেও তারা কেউ গণমাধ্যমে কথা বলেননি। এরপর থেকে উপজেলা প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম মুঠোফোন রিসিভ করা বন্ধ করে দেন। রাত পৌনে ১২টা পর্যন্ত তার মুঠোফোনে চেষ্টা করেও সংযুক্ত করা যায়নি। যদিও রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি ছড়িয়ে পরে যেখানে উপজেলা প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আক্তারুজ্জান খাবারের টেবিলে বসে আছেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, ঘটনার পর গণমাধ্যম এড়াতে উপজেলা প্রকৌশলীকে মোবাইল রিসিভ করতে বারণ করেছেন ইউএনও।
এদিকে ইউএনও নুসরাত ফাতিমা গতকাল রাতে এবং আজকে সকালে দুই ধরণের বক্তব্য দিয়েছেন। গতকাল রাত সোয়া ১০টার দিকে ইউএনও নুসরাত ফাতিমা বলেন, আমি সোনালী ব্যাংকের ওই শাখায় গিয়েছিলাম জুন ক্লোজিংয়ে যেন বিলগুলো দ্রুত সময়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দিয়ে দেয় সেজন্য। বিল কিভাবে দ্রুত পেতে পারেন সেজন্য তিনি, উপজেলা চেয়ারম্যান (কাজী ইমদাদুল হক দুলাল) এবং উপজেলা প্রকৌশলী, সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার একটি সভা করেছিলাম। না হলে টাকা ল্যাবস হয়ে যাবে এবং ঠিকাদারদের বিল দিতে পারব না। অথচ বাইরে ছড়িয়েছে জোর করে বিল দেওয়া হচ্ছে। যা সত্যি নয়। এখন পর্যন্ত বিল কাউকে দেওয়া হয়নি।
তবে আজ সকালে মুঠোফোনে নুসরাত ফাতিমা বলেন, গতকাল উপজেলা প্রকৌশলীর ও উপজেলা চেয়ারম্যানের দুজনের মাথাই গরম ছিল। আমি তাদের দুজনকে দুদিকে সরিয়ে দিয়েছি। এ্যারেস্টেড শব্দটি উপজেলা চ্যেয়ারম্যান বলেছেন।
শব্দটি নারী কণ্ঠের এবং উপজেলা চেয়ারম্যান কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেন কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তাহলে ছড়িয়ে পরা ভিডিওতে কি আছে আসলে আমাকে তা জেনে বলতে হবে।
নুসরাত ফাতিমা বলেন, গতকাল রাত অব্দি আমি, উপজেলা প্রকৌশলী এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আক্তারুজ্জামান মিলন এক সঙ্গে রাতের খাবার খেয়েছি। এখন কেন প্রকৌশলী একথা বলছেন? তাকে ডেকে জানতে হবে।
বাবুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আক্তারুজ্জামান মিলন জানিয়েছেন, ইউএনও ও উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে বার্তা ছিল উপজেলা প্রকৌশলী ঠিকাদারদের টাকা দিতে বাধা দিচ্ছেন। এ খবর পেয়ে ইউএনওর সঙ্গে আমরাও ব্যাংকে যাই। টাকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চারটি ইউনিয়ন পরিষদের সংস্কার বাবদ ১০ লাখ টাকা করে মোট ৪০ লাখ টাকা রয়েছে। এছাড়া এডিপির (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) টেন্ডার হয়ে যাওয়া প্রায় ৬৭ লাখ টাকা রয়েছে। প্রকৌশলীকে কারাদণ্ড দেওয়ার উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ইউএনওর ভ্রাম্যমাণ আদালতে জেল দেওয়ার কথা ছিল অনেকটা কথার কথা।