টানা ৩২ বছর জীবন কেটেছে কারাগারে। দীর্ঘ এই সময়ে সাজার মেয়াদ কমানোর বাসনায় কয়েদি থেকে হন জল্লাদ। পরে ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ফাঁসিও দিয়েছেন ২৬ জনের। ১৯৮৯ সালে সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে নিজের ‘জল্লাদ’ জীবনের সূচনা করেন শাহজাহান ওরফে শাহজাহান ভুঁইয়া। এরপর কারাগারে কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময় আসলেই ডাক পড়ত তার।
এভাবে টানা ৮ বছর জল্লাদের কাজ করার পর ১৯৯৭ সালে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদের স্বীকৃতি দেন। এরমধ্যে ফাঁসি দিয়েছেন ২৬ জনের। যেখানে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয়জন আসামি ছাড়াও চারজন যুদ্ধাপরাধী, জঙ্গি নেতা বাংলাভাইসহ দুজন জেএমবি সদস্য এবং ১৪ জন অন্যান্য আলোচিত মামলার আসামিও ছিলেন।
দীর্ঘ ৩২ বছর পর রোববার (১৮ জুন) দুপুরে কারামুক্ত হন শাহজাহান। জেলগেট থেকে বের হয়েই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। যেন মুক্ত আকাশে কেউ তাকে ছেড়ে দিল! সাংবাদিকদের সামনে কথা বলতে গিয়েই আনন্দে কেঁদে ফেলেন। অথচ, এই লোকটির হাতেই ২৬ জনকে ঝুলিয়ে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।এদিকে, দীর্ঘসময় পর জল্লাদ শাহজাহান রোববার কারামুক্ত হবেন শুনে অনেকেই তাকে একনজর দেখতে ছুটে এসেছিলেন কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ফলে তিনি যখন বের হয়ে আসেন, অনেকেই কাছে গিয়ে তার সঙ্গে ছবিও তোলেন। এ সময় অনেকে তাকে নানা প্রশ্নও করেন।
সদ্য কারামুক্ত শাহজাহান রোববার বেলা ১১টা ৪৭ মিনিটের দিকে কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় তার মুখে ছিল আনন্দের ঝলক। সঙ্গে পরনে ছিল সাদা শার্ট ও প্যান্ট। আর হাতে ছিল একটি কালো ব্যাগ। মাথায় মেহেদীর রঙ রাঙানো লাল চুল। এ সময় তার আশপাশে ছিলেন প্রায় ১০ থেকে ১৫ জন কারারক্ষীও।
পরে উপস্থিত সকলের উদ্দেশে শাহজাহান বলেন, আমার কোনো বাড়িঘর নেই। শুনেছি আমার এক বোন ও ভাগিনা আছে। তবে তাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। কারাগারে পূর্বপরিচিত কিছু লোকজনের সঙ্গে আমি এখন নর্দ্দা (বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়) যাচ্ছি। এ সময় বসুন্ধরা এলাকায় এক ব্যক্তির বাসায় থাকবেন বলেও জানান তিনি।কারাগারে থাকাবস্থায় ২৬ আসামিকে ফাঁসি দেওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারাগারে নিয়ম অনুযায়ী সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের কোনো না কোনো কাজ করতে হয়। আমি একটু সাহসী ছিলাম বলে আমাকে জল্লাদের কাজে নিয়োগ করা হয়। এসব ফাঁসি আমার সিদ্ধান্তে আমি দেইনি, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি দিয়েছি।
৭৩ বছর বয়সী শাহজাহান ভূঁইয়ার গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার পলাশ থানার ইছাখালী গ্রামে। তিনি মৃত হাছেন আলীর ছেলে ও ব্যক্তি জীবনে অবিবাহিত।
কেন্দ্ৰীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ জানিয়েছেন, পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকার কারণে তার আবেদনের প্রেক্ষিতে জরিমানার ১০ হাজার টাকা কারা কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করেছে।
কারা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, শাহজাহান ভূঁইয়া ১৯৯১ সালে গ্রেফতার হন। এরপর তাকে মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে রাখা হয়। কারাগারে ভালো কাজ ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করতে জল্লাদের দায়িত্ব পালনের জন্য তার সাজার মেয়াদ ১০ বছর মওকুফ (রেয়াত) করা হয়। গ্রেফতারের সময় তার নামে ৩৬টি মামলা ছিল৷ এসব মামলায় আদালত শাহজাহানকে ১৪৩ বছরের সাজা দেন। পরে ৮৭ বছরের সাজা মওকুফ করা হয়। এরপর তাকে ৫৬ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সবশেষ ৩২ বছর পর আজ মুক্তি পেলেন শাহজাহান।