রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় সন্তানের মৃত্যুর পর এবার না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন মা মাহবুবা রহমান আঁখি।
রোববার (১৮ জুন) দুপুরে আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী সুমন গণমাধ্যমকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে একই দিন দুপুর সোয়া ২টার দিকে ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আঁখির মৃত্যু হয়।
গত ৯ জুন প্রসব ব্যথা উঠায় রাত ১২টা ৫০ মিনিটে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে মাহবুবা রহমান আঁখিকে ভর্তি করা হয়। যদিও সেই সময়ে সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন না, তারপরও রোগীদের পক্ষ থেকে সংযুক্তা সাহার বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, তিনি আছেন এবং অপারেশন থিয়েটার কাজ করছেন।
ভুক্তভোগীর স্বামী ইয়াকুব আলী জানিয়েছিলেন, তার স্ত্রীকে যখন অটিতে ঢুকানো হয় এবং নরমাল ডেলিভারির জন্য চেষ্টা শুরু করা হয়, তখনও সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে আছেন কি না জানতে চাওয়া হয়। ওই সময়ও কর্তৃপক্ষ জানায়, তিনি আছেন এবং তিনি তার চেষ্টা চালাচ্ছেন। পরে জানা যায় ডা. সংযুক্তা সাহা ছিলেন না এবং তারা রোগীর কোনোরকম চেক-আপ ছাড়াই ডেলিভারির কাজ শুরু করে দেন। এ ঘটনায় ওইদিন রাতেই আঁখি সেন্সলেস হয়ে যায়। পরে শেষ পর্যন্ত তার কোনো ইমপ্রুভমেন্ট হয়নি।এ বিষয়ে শুরু থেকেই আঁখির স্বামী ইয়াকুবের সঙ্গে লুকোচুরি করছিলেন চিকিৎসকরা। একপর্যায়ে ইয়াকুবকে জানানো হয়, সেন্ট্রাল হাসপাতালে তার স্ত্রীর চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। তাকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। পরে স্ত্রীর জীবন বাঁচাতে গত ১০ জুন ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে আঁখিকে ভর্তি করান ইয়াকুব। এরপর সেন্ট্রাল হাসপাতালে এসে জানতে পারেন তার নবজাতক হাসপাতালের এনআইসিইউতে মারা গেছে।
পরবর্তীতে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তির পর সেখানে আঁখিকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়। তবে তার কোনো ইমপ্রুভমেন্ট ছিল না। চিকিৎসকরাও জানিয়েছিলেন, আঁখির ইমপ্রুভমেন্ট হওয়ার সম্ভাবনাও কম। তার শরীরের কিডনি, লিভার, হার্ট এবং অন্য কোনো অংশ কাজ করছিল না। এরমধ্যে ব্রেন স্ট্রোকও করেন আঁখি, সেই সঙ্গে রক্তক্ষরণও বন্ধ হচ্ছিল না তার। ফলে রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়ার কারণে শরীরের অন্য অংশগুলো কাজ করতে ব্যর্থ হয়ে পড়েছিল। এতে হাসপাতালে ভর্তির পুরো সময় তাকে রক্ত দিতে হয় এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তার নিঃশ্বাস চলবে ততক্ষণ পর্যন্ত রক্ত দিতে হবে বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকরা।
দায়ীদের বহিষ্কার
ভুল চিকিৎসা ও কর্তৃপক্ষের প্রতারণায় নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আঁখির চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক-নার্সসহ ১১ জনকে গত ১৪ জুন বরখাস্ত করে। এ বিষয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ডা. আফসানা বলেন, আমরা একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। সেই সঙ্গে সেদিন ডা. শাহজাদীসহ অটি সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক-নার্সসহ উপস্থিত ছিলেন- এমন ১১ জনের সবাইকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। আজকে (১৪ জুন) থেকেই তদন্ত কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদন আসলে ওইদিন আসলেই কী ঘটনা ঘটেছিল সেটা আমরা জানতে পারব। তবে রোগীর স্বজনের অভিযোগ হলো, গাইনি বিভাগ থেকে না কি তাদের জানানো হয়নি যে ডা. সংযুক্তা সাহা ছিলেন না। এমনটি যদি হয়ে থাকে, তাহলে তারা অবশ্যই অন্যায় করেছে।
ডা. আফসানা আরও বলেছিলেন, আমাদের হাসপাতালের অন্যান্য সব রোগী ভর্তি হয় সরাসরি ইমার্জেন্সি বিভাগ হয়ে। তখন রিসিপশন বা ইমার্জেন্সি থেকে আমরা যারা ডিউটিতে থাকি, আমাদের অবহিত করা হয়। কিন্তু গাইনি ডিপার্টমেন্টের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। ওই বিভাগের সব রোগী সরাসরি চলে যায় ৫ তলার গাইনি বিভাগে, কারণ সেখানে রোগীকে কিছু প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের খুব বেশি কিছু জানার সুযোগ থাকে না।
এ বিষয়ে হাসপাতালটির সহকারী পরিচালক বলেন, সেদিন ডা. সংযুক্তা সাহা দুবাই গিয়েছিলেন, কিন্তু হাসপাতাল ম্যানেজমেন্টকে তিনি কিছুই জানিয়ে যাননি। সেদিন রাত দেড়টায় তার ফ্লাইট ছিল তাই রাত সাড়ে ১২টায় তিনি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যান। তিনি চলে গেলেও সেদিন সংযুক্তা সাহার সাথে যে টিম কাজ করে, তারা ছিলেন। পাশাপাশি আমাদের যেই চিকিৎসক থাকেন, ডা. শাহজাদীকে আনা হয়।
ভুল চিকিৎসার কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, এখানে আসলে কোনো ভুল চিকিৎসা হয়নি। এ ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে যদি সংযুক্তা সাহা যে ছিল না, সেটি যদি না জানিয়ে থাকে। এছাড়া চিকিৎসাজনিত কোনো বিষয়ে আমাদের কোনো ভুল হয়নি।
মামলা ও দুই চিকিৎসক গ্রেফতার
এ ঘটনায় গত ১৪ জুন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ধানমন্ডি থানায় সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে একটি মামলা করেছেন আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী। মামলায় আসামি করা হয় সেন্ট্রাল হাসপাতালের ডা. মুনা সাহা (২৮), ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা (৩৮), অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার সহকারী মো. জমির, ডা. এহসান, ডা. মিলি ও সেন্ট্রাল হাসপাতালের ম্যানেজার পারভেজসহ আরও অজ্ঞাত ৫ থেকে ৬ জনকে।
এরমধ্যে ১৪ জুন এজাহারভুক্ত দুই আসামি ডা. মুনা সাহা ও ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানাকে গ্রেফতার করেছে ধানমন্ডি থানা পুলিশ। পরদিন ১৫ জুন গ্রেফতার আসামিদের আদালতে তোলা হলে তাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। সেই সঙ্গে আসামিরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেয়।
হাসপাতালের অপারেশন কার্যক্রম বন্ধসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসা ও কর্তৃপক্ষের প্রতারণায় নবজাতকের মৃত্যু এবং মাহবুবা রহমান আঁখি নামে এক প্রসূতি মৃত্যুঝুঁকিতে পড়ার ঘটনা তদন্তে গত ১৬ জুন হাসপাতালটি পরিদর্শন করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি প্রতিনিধি দল। ওই সময় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত হাসপাতালটিতে সব ধরনের অপারেশন বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের বিষয়েও আলাদা নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্যের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটি।
এরমধ্যে মাহবুবর রহমান আঁখির চিকিৎসাব্যয় সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বহন করা ছাড়াও ভুক্তভোগী রোগীর চিকিৎসায় জড়িত চিকিৎসকদের নিবন্ধন বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ডা. সংযুক্তার প্র্যাকটিসে বিধিনিষেধসহ বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়।