সাত বছর আগে ২০১৫ সালে প্রশান্ত মহাসাগরে এসেছিল এল নিনো। তারপর ২০২৩ সালে আবার তার প্রত্যাবর্তন হয়েছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এনওএএ) বিজ্ঞানীরা। এল নিনো কী, এর প্রভাব কীভাবে বিশ্বে পড়ে সে সম্পর্কে চলুন জেনে নেওয়া যাক।
বিজ্ঞানীরা বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রার চেয়ে মধ্য ও পূর্বাঞ্চলীয় প্রশান্ত মহাসাগর বেশি উষ্ণ হয়ে আছে। সবশেষ ২০১৮-১৯ সালে এ ধরনের এল নিনো পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল। গড়ে ২ থেকে ৭ বছর পর পর এল নিনো পরিস্থিতি হয়।
আরও ভালোভাবে বলতে গেলে- পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের পশ্চিম উপকূল ঘেঁষে পেরু, ইকুয়েডর বরাবর কোনও কোনও বছর ডিসেম্বর মাস নাগাদ এক প্রকার উষ্ণ দক্ষিণমুখী স্রোতের সৃষ্টি হয়। এরই নাম এল নিনো। পেরু, ইকুয়েডর উপকূলেই মাঝেমাঝে এল নিনোর বিপরীত একটি শীতল স্রোত সৃষ্টি হয়। তার নাম লা নিনা। দুই স্রোতের প্রভাব পড়ে বিশ্বের আবহাওয়ায়।
এল নিনোর প্রভাবে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে উত্তরমুখী শীতল পেরু স্রোত বাধাপ্রাপ্ত হয়। এর ফলে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র সাময়িকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ওই অঞ্চলে মৎস্যচাষে ব্যাঘাত ঘটে। সামুদ্রিক প্রাণী এবং পাখিদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে এল নিনো নিম্নচাপের সৃষ্টি করে। যার ফলে ওই এলাকায় অসময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। তবে এই উষ্ণ স্রোতের প্রভাবে কেবল পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরেই সীমাবদ্ধ থাকে না।
নিরক্ষরেখা বরাবর প্রশান্ত মহাসাগরের পানি এল নিনোর প্রভাবে ধারাবাহিক ভাবে উষ্ণ হতে শুরু করে। এর ফলে কোথাও অতিবৃষ্টিতে বন্যা, কোথাও অনাবৃষ্টিতে খরার পরিস্থিতি তৈরি হয়। ২০০০ সাল থেকে এই নিয়ে পঞ্চম বার উষ্ণ স্রোতটির আবির্ভাব হল।
এ বছর এল নিনো আসতে পারে, আগেই তার পূর্বাভাস ছিল। তবে মনে করা হয়েছিল আগস্ট মাসের আগে তার দেখা মিলবে না। কিন্তু সময়ের অনেক আগেই স্রোত বইতে শুরু করেছে সাগরে।
এনওএএর জলবায়ুবিজ্ঞানী মিশেল এল হুরু বলেন, এল নিনো কতটা শক্তিশালী, তার ভিত্তিতে পরিবেশের ওপর বিভিন্ন ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। যেমন বিশ্বজুড়ে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় ভারী বৃষ্টি কিংবা খরার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
চলতি সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া সতর্ক করে বলেছে, দাবানলের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো এল নিনোর প্রভাবে আরও বেশি উষ্ণ ও শুষ্ক হয়ে উঠতে পারে। জাপান বলছে, দেশটিতে বসন্ত ঋতু রেকর্ড মাত্রার উষ্ণ ছিল। আর এর জন্য এল নিনো আংশিকভাবে দায়ী।
বিশ্বে সবচেয়ে উষ্ণতম বছরগুলো রেকর্ড হয়েছে এল নিনো চলাকালে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, চলতি গ্রীষ্মে এবং পরবর্তীকালে স্থলভাগে ও সমুদ্রে রেকর্ড মাত্রার তাপমাত্রা দেখা দিতে পারে।
ত্রাণ সংস্থা ক্রিশ্চিয়ান এইডের সদস্য মারিয়ানা পাওলি বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর কারণে দরিদ্র জনগণ এমনিতেই খরা, বন্যা ও ঝড়ের ঝুঁকিতে আছে। এল নিনোর প্রভাবে এখন তাদের তীব্র মাত্রার তাপমাত্রার মুখোমুখি হতে হবে।
পাওলি মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পরিস্থিতির হাত থেকে তাদের বাঁচাতে সামান্যই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এনওএএর এক বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে গ্রীষ্মকালে এল নিনোর প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম হলেও শরতের শেষ থেকে বসন্ত পর্যন্ত বেশি প্রবল হয়ে ওঠে। এর কারণে দক্ষিণাঞ্চলীয় ক্যালিফোর্নিয়া থেকে শুরু করে উপসাগরীয় উপকূল পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি আর্দ্রতা দেখা দিতে পারে।
এল নিনো তৈরি হওয়ার পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার পর গত মাসে এনওএএর ঘূর্ণিঝড়সংক্রান্ত পূর্বাভাস পাল্টাতে হয়েছে। এল নিনো আটলান্টিক মহাসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের দমিয়ে রাখতে পারলেও মধ্য ও পূর্বাঞ্চলীয় প্রশান্ত মহাসাগরের ঘূর্ণিঝড়কে এটি আরও শক্তিশালী করে তোলে।
সাধারভাবে বছরের এই সময়ে নিরক্ষরেখা বরাবর আয়নবায়ু পশ্চিম দিকে বইতে শুরু করে। এর ফলে দক্ষিণ আমেরিকার দিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের উষ্ণ পানি এশিয়ার দিকে প্রবাহিত হয়।
কিন্তু এল নিনোর প্রভাবে আয়নবায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে। এই বাতাস এশিয়ার দিকে আসার পরিবর্তে পশ্চিম আমেরিকার উপকূলেই থেমে যায়। ফলে নিরক্ষরেখা সংলগ্ন প্রশান্ত মহাসাগরের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক উষ্ণ থাকে।
ভারতে গত ১০০ বছরে ১৮ বার খরা হয়েছে। এই ১৮টি খরার মধ্যে ১৩টির নেপথ্যেই রয়েছে এল নিনোর হাত। প্রশান্ত মহাসাগরের উষ্ণ জল অতীতে ভারতে খরা ডেকে এনেছে বার বার।
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯০০ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত প্রশান্ত মহাসাগরে সাত বার এল নিনোর সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে এল নিনোর দেখা মিলেছে অন্তত ১৫ বার।