চারদিকে কাঠফাটা রোদ। বইছে তীব্র তাপদাহ। প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ মানুষ। এর মধ্যে কয়েকদিন ধরে লোডশেডিংয়ে মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা তৈরি হয়েছে। গরম হয়ে উঠছে ঘরের ফ্যানের বাতাস, পুকুরের পানি। চলমান এ অসহনীয় পরিস্থিতিতে নাকাল অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের মানুষের। শ্রমজীবী মানুষ, শিশু ও বৃদ্ধ মানুষগুলো পড়েছেন বিপদে।এদিকে তীব্র গরমের কারণে দেখা দিয়েছে ডায়রিয়া-আমাশয়-জন্ডিসের মতো পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব।
জেলার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টানা তাপদাহের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন তারা। অনেকেকে প্রয়োজন ছাড়া রোদে বের হতে হচ্ছেন। পথচারীরা সড়কের ধারে, হাটবাজারে যেখানে গাছের ছায়া রয়েছে, সেখানে ছায়ায় গিয়ে ঠান্ডা হওয়ার চেষ্টা করছেন। বাতাস না থাকায় আবহাওয়া উত্তপ্ত থাকার কারণে গাছতলা, ঘরের ফ্যানের বাতাসেও স্বস্তি মিলছে না বলে জানান অনেকে।
জেলা শহরের ভ্যানচালক আরমান আলী জানান, বেলা বাড়তেই তীব্র গরমে ভ্যান চালানো যায় না। রোদের খুব তেজ। তার ওপর লোডশেডিং। ভ্যান সারারাত চার্জ দিতে পারলে সারাদিন চালাতে পারি। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে ভ্যান চার্জও দিতে পারছি না। এতে না পারছি ঠিকমতো ভ্যান চালাতে, আর না পারছি রাতে শান্তিমত ঘুমাতে।
গরম ও লোডশেডিংয়ের কারণে বিপাকে পড়েছেন রোগীরাও। হাসপাতালে অসুস্থ রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে। বিদ্যুতের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে তীব্র গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন রোগীরাও। বেশ কয়েকজন রোগী জানান, প্রচণ্ড গরম, তার মধ্যে ঘন ঘন কারেন্ট চলে যাচ্ছে। খুব অসহনীয় অবস্থায় আছি।
লোডশেডিংয়ের কারণে বিপাকে পড়েছেন বিভিন্ন শিল্পকারখানাগুলো। তেঁতুলিয়ার গ্রিন কেয়ার এগ্রো লিমিটেটের চা কারখানার ম্যানেজার মঞ্জুরুল আলম জানান, লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। অনেক সময় ডিজেল দিয়ে চালালেও সেভাবে সার্ভিস পাচ্ছি না। এমনিতে প্রচণ্ড গরম, এর মধ্যে লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানার শ্রমিকরাও ঠিকমত কাজ করতে পারছে না। খুব বিপাকে আছি।
লোডশেডিং ও লো-ভোল্টেজের কারণে নষ্ট হচ্ছে টিভি, ফ্রিজ, ফ্যানসহ অনেক ইলেকট্রনিক সামগ্রী। টিভি মেরামত করা দোকানগুলোতে দেখা যায়, প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক জিনিসগুলো মেরামত করতে আনছেন। তারা বলছেন, এমনিতে কারেন্ট থাকছে না। তার মধ্যে লো-ভোল্টে। লোডশেডিংয়ের পর হঠাৎ করে লাইন আসায় ভোল্টেজ বাড়ার কারণেও সমস্যা হচ্ছে, লো-ভোলটেজের কারণেও সমস্যা হচ্ছে।
প্রখর রোদের কারণে গলে যাচ্ছে সড়কের বিটুমিন (পিচ)ও। পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়া-বাংলাবান্ধা জাতীয় মহাসড়কে (এশিয়া হাইওয়ে) চলমান সংস্কার কাজের সড়কের বিটুমিন গড়ে যেতে দেখা গেছে। যানবাহনের চাকায় পিচ আটকে যাওয়ায় চালকরা ধীর গতিতে যানবাহন চালাচ্ছেন। সড়ক হয়ে পিচ্ছিল হয়ে উঠায় দূর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে সড়ক বিভাগ রাস্তায় মোটা বালি ছিটিয়ে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন।
এদিকে খরা মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির নিম্নস্তরে চলে যাওয়ায় পানি সংকটে কয়েক গ্রামের মানুষ। তারা হস্তচালিত নলককূপগুলোতে পানি মিলছে না। অনেক জায়গায় মোটর পাম্প বসিয়ে প্রয়োজনীয় পানি মিলছে না বলে জানান তেঁতুলিয়ার দর্জিপাড়া এলাকার ফিরোজা আক্তার, সিদ্দিক নগর এলাকার পারভীনসহ কয়েকজন নারী। তারা জানান, এমনিতে টিউবওয়েলে পানি পাচ্ছি না, প্রতিবেশির বাড়ি থেকে পানি আনতে হয়। তার মধ্যে লোডশেডিংয়ের কারণে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় পানির জন্য। সন্তানাদি নিয়ে খুব কষ্টে আছি।
গরমের কারণে বেড়েছে ডায়রিয়া, আমাশয়ের মতো রোগ ব্যাধি। প্রতিদিনই এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছেন জেলার হাসপাতালগুলোতে। জেলা আধুনিক সদর হাসপাতালে তথ্য নিয়ে জানা যায়, গত দুই সপ্তাহে গরমের কারণে প্রায় দুই শ মানুষ ডায়েরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, আবহাওয়া পরিবর্তন, প্রচণ্ড গরম, রোটা ভাইরাস ও ফুড পয়জনিংজনিত কারণে ডায়রিয়া দেখা দিয়েছে। তবে এক সপ্তাহে ৬৬ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে। এদের মধ্যে বেশি ভাগই শিশু। এ জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। বেশি বেশি তরল খাবার দিতে হবে। এছাড়াও খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী (অতি.) আব্দুল মান্নান দেওয়ান বলেন, আপনারা সবাই অবগত যে এটা জাতীয় সমস্যা। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। আশা করছি সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।
জেলার প্রথম শ্রেণির তেঁতুলিয়া আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাসেল শাহ বলেন, দিনের তাপমাত্রা ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রেকর্ড হচ্ছে। বৃহস্পতিবার (৮ জুন) বিকেল ৩টায় দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৮ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। গরমের তীব্রতা পুরো এ সপ্তাহ চলতে পারে বলে জানান এ কর্মকর্তা।