যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন সম্প্রতি ঘোষণা দেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে তাকে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে হবে। বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু নিজেও ‘বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের প্রচারণার’ বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
এ বিষয়টিকে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রসহ চার দেশের কূটনীতিকের ওপর থেকে অতিরিক্ত নিরাপত্তা তুলে নেওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবেও দেখছেন অনেকেই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেন, দেশটি (যুক্তরাষ্ট্র) তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। বাংলাদেশ ছাড়াও এর আগে বিভিন্ন দেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে নাক গলাতে দেখা যায়।
ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়া ট্যুডের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ঐতিহাসিকভাবেই বিভিন্ন দেশের সরকার পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতার নজির রয়েছে। আগে তারা এ ধরনের কাজে সরাসরি যুক্ত ছিল। যেমনটা আমরা দেখতে পাই হাওয়াই, কিউবা ও ক্যারিবীয় দেশগুলোর ক্ষেত্রে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবং ১৯৪৭ সালে সিআইএ প্রতিষ্ঠার পর এ ধরনের কাজ বেশ গোপনীয়তার মধ্যেই হচ্ছে। ১৯৫৩ সালে ইরানে, ১৯৫৪ সালে গুয়েতেমালায় এবং ১৯৬৩ সালে ভিয়েতনামে একই ধরনের চিত্র দেখা যায়।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক হতে পারে সে বিষয়টি নিয়ে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাবিগনিউ ব্রেজেজিনস্কি।
তবে একটি মাত্র কারণের ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো দেশে হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায়নি। যদিও আপাতদৃষ্টিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়গুলো বলা হচ্ছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত কারণ আসলে মার্কিন স্বার্থ। অতীতেও প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রকে জটিল ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন আধিপত্য বিস্তারের জন্য তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে পড়ে। সে সময় সোভিয়েত জোট ভারতকে মোকাবিলা করতে পাকিস্তানের মতো দেশগুলোকে সমর্থন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত অবস্থান, এর মূল্যবান সম্পদ, বাণিজ্য পথ, বাজার, নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার কারণেই এ অঞ্চল যুক্তরাষ্ট্রের এত মাথাব্যথার কারণ। আফগানিস্তানের মতো দেশগুলোতে সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টা, বাংলাদেশের মতো মানবিক উদ্বেগ এবং চীনের মতো অর্থনৈতিক উদ্বেগ সবই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মার্কিন হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্তে কাজ করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বর্তমানে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আফগানিস্তানে মার্কিন হস্তক্ষেপ দেশটিকে সবদিক থেকেই ভঙ্গুর করে দিয়েছে। বাদ যায়নি পাকিস্তানও। এর আগে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছিলেন, নিজেদের সব ধরনের জঞ্জাল পরিষ্কার করার জন্য পাকিস্তানকে দরকারি বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। তারা আফগানিস্তানে তাদের সৈন্যদের অস্ত্র সরবরাহের জন্য পাকিস্তানকে ব্যবহার করেছে।
আফগানিস্তানে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় পাকিস্তানের পেছনে প্রায় তিন কোটি ডলার ব্যয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) গণহত্যা চালানোর সময়ও পশ্চিম পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে গেছে মার্কিন প্রশাসন। কিন্তু পাকিস্তানে বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় যুক্তরাষ্ট্র গা বাঁচিয়ে চলছে।
বিভিন্ন পরিস্থিতি থেকে স্পষ্টভাবেই এটা বলা যায় যে, বিশ্বজুড়ে নিজেদের আধিপত্য নিশ্চিত করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। গণতন্ত্রের মূল্যবোধে ‘মুক্ত বিশ্বের’ অবস্থানে নিজেদের নেতা হিসেবে দাবি করে আসছে বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসন। কিন্তু গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে দেশগুলোর বিরুদ্ধে তাদের পর্যবেক্ষণ, চাপ ও নিষেধাজ্ঞা সমানভাবে আরোপ করা হচ্ছে বলে চোখে পড়ছে না।
ইন্ডিয়া ট্যুডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের আর বেশি সময় হাতে নেই। এই সময়টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উচিত অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টি মোকাবিলা করা। যুক্তরাষ্ট্রে হস্তক্ষেপের বিষয়ে পূর্বাভাস দিয়ে সম্প্রতি তিনি সংসদে বলেন, তারা গণতন্ত্র মুছে ফেলার চেষ্টা করছে এবং এমন একটি সরকার চালু করার চেষ্টা করছে যার গণতান্ত্রিক অস্তিত্ব থাকবে না, এটি একটি অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ হবে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতকেও পরিস্থিতি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে মার্কিন হস্তক্ষেপের ফলে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পরবর্তী এলাকায় নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একইভাবে উত্তরপূর্ব সীমান্তের ওপারেও একই পরিস্থিতি হলে আরও জটিলতা দেখা দেবে। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন দেশের জন্য এখন আর কোনো বিশ্বনেতার প্রয়োজন নেই। প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল এ বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের এখন উচিত স্থানীয় জনগণকেই তাদের দেশের ভালো-মন্দ নির্ধারণ করতে দেওয়া। তারপরেও যদি যুক্তরাষ্ট্র এখনো মুক্ত বিশ্বের দলনেতার ভূমিকা পালন করতে চায়, তবে তাদের উচিত আফগানিস্তান দিয়েই শুরু করা।