বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাওয়ার পর কয়লার অভাবে বেশ কয়েকবার বন্ধ ছিল রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হওয়ার পর চার মাসে মোট তিন দফায় বন্ধ হয়েছে কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের উৎপাদন। যার প্রভাব পড়েছে সরাসরি বিদ্যুৎ সরবরাহে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলার সংকটের ফলে কয়লা আমদানির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে না পারায় এমন বিপত্তি ঘটছে। ফলে আসন্ন জুনে চালু হতে যাওয়া দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদন নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।
২০২২ সালের ১৭ ডিসেম্বর আলোচিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে আসে। উৎপাদনে আসার ২০ থেকে ২২ দিন পর আমদানি করা কয়লার মজুত শেষ হয়ে যায়। রিজার্ভ কয়লা দিয়ে কয়েক দিন চালু রাখার পর ১৪ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো বন্ধ হয় ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট।
কয়লার সরবরাহ স্বাভাবিক করে কেন্দ্রটি চালু করার দুই মাস পর ১৫ এপ্রিল যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দ্বিতীয়বারের মতো বন্ধ হয় উৎপাদন। তিন দিনের ব্যবধানে সচল হলেও পাঁচ দিনের মাথায় ফের হোঁচট খায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। ফলে ২৩ এপ্রিল তৃতীয়বারের মতো কয়লার সংকটে বন্ধ হয় রামপাল।
জানা যায়, ইন্দোনেশিয়া থেকে তিন ধাপে আমদানি করা কয়লার প্রথম চালান পৌঁছলে ১৬ মে থেকে ফের শুরু হয় কেন্দ্রটির উৎপাদন। প্রথম চালানে আসে নয় হাজার টন কয়লা। ধাপে ধাপে আরও ১০ ও ৩০ হাজার টন কয়লা পৌঁছলেও তা দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে চালু রাখা যাবে সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ।
১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটটি চালু রাখার জন্য প্রতিদিন প্রয়োজন পাঁচ হাজার টন কয়লার। কিন্তু অধিকাংশ সময় ইউনিটটি সক্ষমতার কম-বেশি উৎপাদন করে আসছে। প্রথম ইউনিট ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন হলেও সর্বোচ্চ উৎপাদন করছে ৫৬০ থেকে ৫৭০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৪৬০ মেগাওয়াট ঢাকার জাতীয় গ্রিডে এবং বাকি বিদ্যুৎ খুলনা-বাগেরহাটে সরবরাহ করা হয়। যা চাহিদা অনুযায়ী যথেষ্ট নয়।
বাগেরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, পিক আওয়ারে ৯৪ মেগাওয়াট চাহিদা থাকলেও বরাদ্দ মিলছে ৫৫ থেকে ৬০ মেগাওয়াট। অপরদিকে, অফ পিক আওয়ারে ৮০ থেকে ৮২ মেগাওয়াট চাহিদা থাকলেও বরাদ্দ আসছে ৪৫ থেকে ৫০ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ডলার সংকটে ঋণপত্র খুলতে না পারায় কয়লা আমদানির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যাচ্ছে না। ফলে বারবার বন্ধ করতে হচ্ছে উৎপাদন। জুন মাসে রামপালের ৬৬০ ক্ষমতাসম্পন্ন দ্বিতীয় ইউনিট চালু হলে প্রতিদিন প্রয়োজন পড়বে ১০ হাজার টন কয়লার। বর্তমান পরিস্থিতিতে যা জোগান দেওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপ-মহাব্যবস্থাপক আনোয়ারুল আজিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে ৫০ হাজার টন কয়লা এসেছে। সামনে আরও ৫০ হাজার টন কয়লা আসবে। আমাদের মোট এক লাখ টন কয়লার ক্রয়াদেশ ছিল। সেটাই ধাপে ধাপে আসছে। মূলত, সংকট তো হচ্ছে ডলার নিয়ে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি, যেন এ সংকট মোকাবিলা করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যায়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হবে কি না– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি।’
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন,বিদ্যুৎ খাতে যথাযথ পরিকল্পনার অভাবের প্রতিফলন রামপাল। পরিকল্পনা না থাকায় বারবার কেন্দ্রের ইউনিট বন্ধ রাখা হচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির আগে একটি যথাযথ পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল। কীভাবে জ্বালানির জোগান দেওয়া হবে, সেটা নিশ্চিত করা উচিত ছিল। কিন্তু পরিকল্পনায় ভুল থাকায় বারবার কয়লার অভাবে রামপালের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পুরোপুরি মাত্রায় আমদানি নির্ভর না হয়ে একটি বিকল্প ব্যবস্থা রাখার প্রয়োজন ছিল, যাতে বিরূপ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়।