করোনা মহামারিতে প্রায় ১৪ মাস ধরে বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরাসরি পাঠদান। বন্ধ আছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা। থমকে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রম। তবে শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে নিতে অনলাইনে ও দূরশিক্ষণ পদ্ধতির পাঠদান চলছে। স্কুল-কলেজে অভ্যন্তরীণ কিছু পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে অনলাইনে। কিন্তু তাতে শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্দেশ্য পুরোপুরি পূরণ হচ্ছে না। বরং বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। দফায় দফায় পিছিয়ে যাচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার তারিখ। সবমিলে পৌনে ৪ কোটি ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনায় শিক্ষার ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি এবং সুদূরপ্রসারী। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকরাও নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন। তাই সার্বিক শিক্ষা পুনরুদ্ধারে সুচিন্তিত পরিকল্পনা নেওয়া দরকার বলে মনে করেন তারা।
প্রবীণ শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন অবরুদ্ধ ৯ মাসে লেখাপড়ার একটা বড় ক্ষতি হয়েছে। এরপর গত ৫০ বছরেও শিক্ষায় এতবড় ক্ষতির সম্মুখীন আর হয়নি। তিনি বলেন, শিক্ষা পুনরুদ্ধারের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু যেটা চলে গেছে সেটা উদ্ধার সম্ভব নয়। বরং এখন এই ধকল কাটিয়ে উঠতে অন্য দেশের অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে নিজস্ব প্রয়োজন ও বাস্তবতার নিরিখে উপযুক্ত পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। যদি একসঙ্গে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা না যায়, তাহলে যেখানে যখন পরিস্থিতি উন্নতি হবে, সেখানে আগে খুলে দেওয়া যেতে পারে। এটাই বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হতে পারে।
গত বছর ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এ বছর ৩০ মার্চ খুলে দেওয়ার ঘোষণা ছিল। করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ছুটি ২২ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের জন্য অনলাইনে ও দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে বিকল্প পাঠদান পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে সব শিক্ষার্থীর কাছে তা পৌঁছাচ্ছে না। গণসাক্ষরতা অভিযানের (ক্যাম্পে) গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত সমীক্ষা বলছে, প্রায় ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণে অংশ নিয়েছে। ব্র্যাকের সমীক্ষা মতে, টেলিভিশন পাঠদানে ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। অর্থাৎ অন্তত অর্ধেক শিক্ষার্থীই দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের বাইরে। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণের অধীনে এসেছে। আর স্কুল শিক্ষকদের মাধ্যমে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে ৮৫ শতাংশকে লেখাপড়ার মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, করোনায় শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও সমাজের ওপর নানান দিক থেকে প্রভাব পড়তে পারে। এর অন্যতম- শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ এবং শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার। এই ৫টির প্রত্যেকটি বেড়ে যেতে পারে। করোনার ফলে শিক্ষার্থীরা দুই কারণে আর স্কুলে নাও ফিরতে পারে। প্রথমটি- দীর্ঘ শিখন বিরতির কারণে একটি অংশ পাঠ না পারা ও বোঝার পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। দ্বিতীয়টি- সম্ভাব্য দারিদ্র্যের কশাঘাতে নিপতিত হয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজে ভিড়ে যেতে পারে। আর ঝরে পড়া এসব শিক্ষার্থীর মেয়ে শিশুদের বিয়ে হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে মাধ্যমিকে ঝরেপড়াদের ক্ষেত্রে এটা বেশি ঘটতে পারে। এই বিষয়ের সঙ্গে সন্তান জন্ম দেওয়া ও মৃত্যুর সম্পর্ক বিদ্যমান। এমনটি ঘটলে বহু কষ্টে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ শিক্ষা, নারী শিক্ষা ও মাতৃ-শিশু মৃত্যুতে যে অর্জন করেছে তা ম্লান হওয়ার শঙ্কা আছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, এটা ঠিক যে করোনায় শিক্ষার ক্ষতি অপরিমেয়। এ সমস্যা বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের। প্রত্যেক জাতিই নিজস্ব সুবিধা ও পদ্ধতি অনুযায়ী উত্তরণের কার্যক্রম চালাচ্ছে। আমরাও করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকেই সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। দূরশিক্ষণ ও অনলাইন পদ্ধতিতে পাঠদান চলছে। শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে নিয়ে খোঁজখবর রাখা, অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার মাধ্যমে পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে চলমান রাখা, এমনকি তাদেরকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখার জন্যও কাজ করতে হচ্ছে। যার সুফলও মিলেছে। বিশেষ করে যেখানে অনলাইন ‘অ্যাকসেস’ ভালো আছে, সেখানে সরাসরি পাঠদানের ‘গ্যাপ’ অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। অ্যাসাইনমেন্টও এ ক্ষেত্রে বড় রকমের সহায়তা করেছে। তবে যখন যে পন্থাই গ্রহণ করা হয়েছে সেখানে ‘জীবন আগে’- এই নীতি গ্রহণ করতে হচ্ছে। ঈদের পর যদি খুলে দেওয়া সম্ভব না হয় তাহলে বিকল্প পদ্ধতির পাঠদান আরও জোরালো করা হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এবার এসএসসি পরীক্ষার্থীরা প্রিটেস্ট বা টেস্ট পরীক্ষা দিতে পারেনি। এসএসসি পরীক্ষার্থীরা দশম শ্রেণিতে ক্লাস করতে পেরেছে মাত্র আড়াই মাস। এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা দ্বাদশ শ্রেণিতে অটো পাশ নিয়ে উঠেছে। দ্বাদশ শ্রেণিতে একদিনও সরাসরি ক্লাস করতে পারেনি তারা। এ কারণে সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচিতে তাদের পরীক্ষা নেওয়া হবে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের বয়স ও স্তর অনুযায়ী জানার পরিসর কমে যেতে পারে। যদিও এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেছেন, বয়স এবং আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী জ্ঞানগত দিক অক্ষুণ্ন রেখেই এই সিলেবাস তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে গত বছর বিলম্বে ভর্তি করা একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রথম বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার সময় এসে গেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা একদিনও ক্লাসে বসতে পারেনি।
এদিকে করোনায় আরেক বড় ক্ষতিগ্রস্ত খাত উচ্চশিক্ষা। শুরুর কিছুদিন পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রথমে অনলাইনে ক্লাস এবং পরে পরীক্ষা নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। সংক্রমণ কমার পর গত ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনার্স শেষ বর্ষ/সেমিস্টার এবং মাস্টার্সের পরীক্ষাও নেয়। কিন্তু অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার অনুমতি বাতিলের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝপথে বিভিন্ন সেমিস্টারের পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। আর আগের সেমিস্টারের পরীক্ষা নিতে না পারায় এখন অনলাইনে পরবর্তী সেমিস্টারের ক্লাসও স্থগিত আছে বলে জানা গেছে। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোতেও শত শত পরীক্ষা স্থগিত করতে হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এমন পরিস্থিতিতে করোনায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক থেকে দেড় বছরের সেশনজট তৈরি হয়েছে। আর প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই বন্ধ আছে গবেষণা কার্যক্রম।
মূল্যায়ন ও পরীক্ষা : সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শুধু শিক্ষাক্রম আর পাঠদান নয়, পরীক্ষা বা মূল্যায়নের কাজটিও অনেক বিঘ্নিত হয়েছে। বিগত বছরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো পরীক্ষাই নেওয়া যায়নি। যদিও এর পরিবর্তে অ্যাসাইনমেন্ট আর নিজস্ব পদ্ধতিতে মূল্যায়নের ভিত্তিতে স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের পদোন্নতি দেওয়া হয় গত বছর। কিন্তু করোনা শুরুর আগে এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হলেও গত বছরের পিইসি, জেএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদেরকে আগের দুই পরীক্ষার ফল মূল্যায়ন করে গ্রেড দেওয়া হয়েছে। এ বছরের জেএসসি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো ঘোষণা আসেনি। পিইসি, এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষা ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এসব নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। কেননা, আগামী জুনের পর দুই মাসের ব্যবধানে এই এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার কথা। পরীক্ষার আগে যথাক্রমে ৬০ ও ৮৪ দিন ক্লাস নেওয়ার কথা আছে এসব পরীক্ষার্থীর। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সেটা কতটা সম্ভব হবে সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে। যদিও এসব পরীক্ষা নেওয়ার লক্ষ্যে শিক্ষা বোর্ডগুলো ফরম পূরণ করাচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের। এছাড়া প্রশ্নপত্র তৈরি ও মুদ্রণের কাজ করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব অধ্যাপক তপন কুমার সরকার।