বেশি মূল্যে জমি অধিগ্রহণের অর্থ হাতিয়ে নিতে সব ধরনের কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর পরিবার। নিজ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ প্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রথমে তিনি প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকার জমি পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনের নামে কেনার ব্যবস্থা করেন। এ কাজে ব্যবহার করা হয় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও দলীয় ক্যাডারদের। দাম বাড়াতে নাল শ্রেণির জমি মাটি ভরাট করে উঁচু করা হয়।
এরপর কাগজ-কলমে শ্রেণি পরিবর্তন করতে তিনি ডিও লেটার দেন আইন মন্ত্রণালয়ে। অতঃপর রাতারাতি নাল শ্রেণির জমি কাগজ-কলমে হয়ে যায় ভিটি শ্রেণি। এদিকে সবকিছু যখন ঠিকঠাক তখন প্রতারণামূলক এ উদ্যোগে বাগড়া দেন সাহসী জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ। তিনি বুঝতে পারেন এভাবে অধিগ্রহণের দর প্রস্তাবের নথিতে সই করলে সরকারের প্রায় একশ কোটি টাকার ক্ষতি হবে।
যদিও লাভবান হবে মন্ত্রী জাহিদ মালেকের পরিবার। কিন্তু ভবিষ্যতে এ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হলে প্রথমেই ফেঁসে যাবেন তিনি। এরপর জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। আলোচিত ঘটনাটি ঘটেছে মানিকগঞ্জে। সংশ্লিষ্ট ইডিসিএল (এসেনসিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড) প্রকল্পটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। মানিকগঞ্জ সদর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নিজ এলাকা। নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো যুগান্তরকে জানিয়েছে, সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইডিসিএল’র প্লান্ট স্থাপন প্রকল্পের শুরুতে এভাবে বাসা বেঁধেছে দুর্নীতি।
সম্ভাব্য দুর্নীতি ঠেকাতে যুক্তি তুলে ধরে আপত্তি জানিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন ডিসি। এরপর আটকে গেছে পুরো প্রক্রিয়া। অধিগ্রহণ কারসাজিতে ডিসি বাধা দেওয়ায় মন্ত্রীর সঙ্গে ডিসির এক ধরনের অদৃশ্য বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। তবে ডিসির এই সাহসী উদ্যোগকে সমর্থন দিচ্ছেন মন্ত্রণালয়ের অধিকাংশ কর্মকর্তা। প্রসঙ্গত, ঢাকার তেজগাঁওয়ে অবস্থিত ইডিসিএল’র পুরাতন প্লান্ট মানিকগঞ্জে সরিয়ে নিতে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়।
যার নাম ‘এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড, মানিকগঞ্জ প্লান্ট স্থাপন’ প্রকল্প। সম্প্রতি প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সরকারি অর্থ লোপাটের অপচেষ্টার অভিযোগে স্থানীয় জেলা প্রশাসন বেঁকে বসায় আটকে গেছে ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া। আলোচিত চিঠি : সরকারি অর্থ লোপাটে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছক তুলে ধরে ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় চিঠি পাঠায় মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসন (স্মারক নম্বর ০৫.৩০.৫৬০০.৩০৩.০২.০০৫.২১-৪২)।
এতে বলা হয়, ‘ইডিসিএল প্লান্ট স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মানিকগঞ্জ সদর উপজেলাধীন ৮৪ নম্বর মেঘশিমুল মৌজায় ৩১.৫ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব পাওয়া গিয়েছে। উক্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের নিমিত্তে জমি অধিগ্রহণের লক্ষ্যে ২৭ ডিসেম্বর সম্ভাব্যতা যাচাই এবং ১৭ জানুয়ারি জেলা ভূমি বরাদ্দ কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন, জেলা ভূমি বরাদ্দ কমিটির সভার সিদ্ধান্ত ও দাখিলকৃত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রস্তাবিত ভূমির শ্রেণি নাল হলেও সাম্প্রতিককালে বালু ভরাট করে ভিটি শ্রেণি করা হয়েছে এবং একই সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে মহাপরিদর্শক নিবন্ধনের স্মারকে (নম্বর ১০.০৫.০০০০.০০৪.৯৯.০০৭.২১-৭৭.) জেলার অন্য কোনো মৌজার রেট পরিবর্তন না করলেও শুধু ৮৪ নম্বর মেঘশিমুল মৌজার ভিটি/বাড়ি শ্রেণির সরকারি মূল্য প্রতি শতকে পঁচিশ হাজার টাকার পরিবর্তে এক লাখ বিশ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।
কেননা আশপাশে মৌজার সমশ্রেণির জমির মৌজারেট অনেক কম।’ চিঠিতে আশপাশের আরও চারটি মৌজায় জমির মূল্যসহ তুলনামূলক বিবরণী তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, আলোচিত ৮৪ নম্বর মেঘশিমুল মৌজায় প্রস্তাবিত ৩১.৫ একর জমি অধিগ্রহণে সরকারের খরচ হবে ১১৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অথচ জমির প্রকৃত শ্রেণি নাল হিসাবে অধিগ্রহণ করা হলে খরচ হওয়ার কথা মাত্র ৬৩ কোটি ৭৭ লাখ ৭১ হাজার ৫০ টাকা।
জেলা প্রশাসন বলছে, প্রস্তাবিত জমি আসলে ভিটি শ্রেণির নয়। হঠাৎ বালু ফেলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে শ্রেণি পরিবর্তনকৃত জমি অধিগ্রহণ করা হলে সরকারের প্রায় তিন থেকে দশগুণ পর্যন্ত অর্থ অতিরিক্ত খরচ হবে। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৬০ থেকে ১০০ কোটি টাকা। কাজেই প্রস্তাবিত জমির পরিবর্তে একই মৌজার অন্য কোনো জমি অথবা পার্শ্ববর্তী কোনো মৌজায় জমি অধিগ্রহণ করা যেতে পারে।
এতে সরকারের অতিরিক্ত অর্থ সাশ্রয় হবে এবং প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে মনে করে জেলা প্রশাসন। সরেজমিন মানিকগঞ্জ : জেলা প্রশাসনের চিঠির সূত্র ধরে ১৬ মে মানিকগঞ্জের মেঘশিমুল মৌজায় প্রস্তাবিত জমিতে হাজির হয় যুগান্তর প্রতিবেদক। জমিতে ঢোকার মুখে শুকিয়ে যাওয়া ধলেশ্বরী নদের ওপর নবনির্মিত সেতু। পাশ দিয়ে সরু মেঠোপথ চলে গেছে লোকালয়ের দিকে।
সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে থাকা স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়। সরকারি ওষুধ তৈরির কারখানার (ইডিসিএল প্রকল্প) জমি সম্পর্কে জানতে চাইলে তাদের একজন অপরজনের দিকে তাকান। একজন বলেন, ‘কই, এখানে সরকারি ওষুধ কারখানার কথা তো তারা শেনেননি। তবে সামনে গেলে মন্ত্রীর (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) জমিতে বালু ভরাটের কাজ চলছে দেখতে পাবেন। সেখানে মন্ত্রীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হবে এমন কথা তারা শুনেছেন।’
স্থানীয়দের দেখানো পথ ধরে মিনিট দশেক হাঁটলে সদ্য বালু ভরাট করা বিশাল ফাঁকা জায়গা দেখা যায়। সীমানা ঘেঁষে বাঁশের খুঁটিতে উড়ছে লাল নিশান। চারপাশে প্রায় সবই নিচু কৃষিজমি। ধান ও ভুট্টার বিস্তীর্ণ মাঠ। পূর্বদিকে ধলেশ্বরী নদী। পশ্চিমে সরু মাটির রাস্তা। জমির উত্তরে ৪-৫টি আধাপাকা টিনের বাড়ি দেখা যায়। সেদিকে কিছুটা এগোলে স্থানীয় রিকশাচালক আবু হানিফের সঙ্গে দেখা হয়।
বালু ভরাট করা এই বিশাল জমির মালিক কে জানতে চাইলে হানিফ এক বাক্যে বলেন, ‘মন্ত্রী।’ এরপর পূর্বদিকে আঙুল উঁচিয়ে তিনি বলেন, ‘ওই যে দূরে লাল নিশান দেখা যায়। ওই পর্যন্ত সবই মন্ত্রীর জমি।’ ভরাটকৃত বালুর ওপর দিয়ে হাঁটলে পশ্চিম কোণে একটি টিনের টং দোকান পাওয়া যায়। দোকানির নাম মঙ্গল বয়াতি। তিনি অন্ধ।
কাছে গিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয় কতদিন এখানে দোকানদারি করেন। মানিকগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় বয়াতির উত্তর-‘বেলা তো অনেকদিন হলো। ১৫ বছরের কম নয়। পালটা প্রশ্ন করে মঙ্গল জানতে চান, কোথা থেকে এসেছেন এখানে। কার বাড়ির মেহমান। মন্ত্রীর জমি দেখতে ঢাকা থেকে এসেছি শুনে মঙ্গল বলেন, ‘তার দোকানটাও পড়েছে মন্ত্রীর জায়গায়।
তাই মন্ত্রী যখন সীমানা প্রাচীর ঘেরা শুরু করবে তখন হয়তো তাকেও এখান থেকে অন্যত্র চলে যেতে হবে।’ সেখানেই কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। মন্ত্রী এসব জায়গা কখন কিনেছেন জানতে চাইলে মোহাম্মদ আলী কিছুটা ইতস্তত বোধ করেন। বলেন, কখন কিনেছেন তা আমরা ভালো জানি না। তবে জায়গা মন্ত্রীর। এটা তো এখানকার সবাই জানে।
তার সঙ্গে সুর মেলান দোকানে বসে থাকা স্থানীয় আরও কয়েকজন। তবে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তাদের কেউই আর বেশি কথা বলতে রাজি হলেন না। দু’একজন তড়িঘড়ি সরে পড়লেন সেখান থেকে। লাঠিয়াল : স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সংশ্লিষ্ট জমি কেনার ক্ষেত্রে লাঠিয়াল হিসাবে ভাড়ায় খাটেন স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কিছু নেতা।
এছাড়া স্থানীয় কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন মধ্যস্থতাকারী। এদের মধ্যে গড়পাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আফসার উদ্দিন সরকার ও পার্শ্ববর্তী জাগীর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন অন্যতম। এছাড়া জমি কেনায় ভূমিকা রাখেন জনৈক খালেক ও ওবায়দুর নামের স্থানীয় পাতিনেতা। এদের মধ্যে আফসার উদ্দিন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ‘খাস লোক’ বলে এলাকায় পরিচিত। আর জাগীর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের ছেলের বিয়েতে উকিল ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সেই সূত্রে মন্ত্রীর সঙ্গে জাকির চেয়ারম্যানের আত্মীয়তা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা থেকে ইডিসিএল’র প্লান্ট মানিকগঞ্জে স্থানান্তরের প্রস্তাব পূর্বপরিকল্পিত। প্রস্তাবিত জমির কাছেই গড়পাড়া ইউনিয়নে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর গ্রামের বাড়ি। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বেশ কয়েক বছর ধরে মেঘশিমুল মৌজায় বিশাল আয়তনের জমি কেনা হয়। এরপর জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে আধা সরকারি পত্র (ডিও) দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। পরে ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি নিবন্ধন মহাপরিদর্শকের দপ্তর থেকে আলোচিত জমির শ্রেণি পরিবর্তন সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
এভাবে জমির শ্রেণি পরিবর্তন আইনসম্মত হয়েছে কিনা-এমন প্রশ্ন তুলে জেলা প্রশাসনের চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘মেঘশিমুল মৌজার অধিকাংশ জমির শ্রেণি নাল। বাস্তবে ভিটি শ্রেণির জমি খুব বেশি পাওয়া যায় না।’ কিন্তু নিবন্ধক মহাপরিদর্শকের দপ্তর থেকে এভাবে আশপাশের জমির শ্রেণি অপরিবর্তিত রেখে শুধু একটি মৌজায় জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা উদ্দেশ্যমূলক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রভাবশালীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেওয়ায় নানাবিধ চাপের মুখে পড়েছে স্থানীয় জেলা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারি স্বার্থ রক্ষায় তারা অনড়। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কয়েকজন ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তারা মনে করেন এ ধরনের সুস্পষ্ট দুর্নীতির দুরভিসন্ধি প্রধানমন্ত্রীর নজরে এলে তিনি অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন।
বক্তব্য : ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ ১৬ মে তার কার্যালয়ে বলেন, জেলা ভূমি অধিগ্রহণ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রস্তাবিত জমি অধিগ্রহণ করা হলে সরকারের বিপুল অঙ্কের অর্থের অপচয় হবে। যেহেতু জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব হচ্ছে সরকারের স্বার্থ রক্ষা করা। তাই প্রস্তাবিত জমি অধিগ্রহণের আগে বিস্তারিত জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর বেশি কিছু তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।
আলোচিত জমি অধিগ্রহণ নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বক্তব্য জানার চেষ্টা করে। সোমবার মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, সরকারি সফরে মন্ত্রী দেশের বাইরে আছেন। পরে মন্ত্রীর হোয়াটঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠিয়ে বক্তব্য দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময় পরও মন্ত্রীর তরফ থেকে কোনো বক্তব্য আসেনি। পরে রাত ৯টা ২৬ মিনিটে আলোচ্য সংবাদের বিষয়ে মন্ত্রীর বক্তব্য পেতে সহযোগিতা চেয়ে মন্ত্রীর একান্ত সচিব রেয়াজুল হকের হোয়াটঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু রাত সাড়ে ১০টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তার পক্ষ থেকেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।