এসময় দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে বলা হতো ‘রক্তাক্ত জনপদ’। যেখানে লুটতরাজ, জিম্মি, অপহরণ ও খুন ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এসব অঞ্চলকে রক্তাক্ত জনপদে পরিণত করেছিল কথিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এমএল, জনযুদ্ধ, সর্বহারাসহ ১৪টির বেশি চরমপন্থি গোষ্ঠী। তারা আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে বন্দুকের নলের ডগায় রাজত্ব কায়েম করতে চেয়েছিলেন। সাধারণ মানুষও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তাদের নিয়মিত চাঁদা দিতে বাধ্য ছিলেন। এসব অঞ্চলের প্রতিটি পরিবার থেকে সামর্থ্যবান পুরুষকে বাধ্য হয়ে যোগ দিতে হতো চরমপন্থি দলে। অন্যথায় পুরো পরিবারকে হতে হতো নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার।
এই চরমপন্থিদের দাপটে রাত গভীর হলেই কলাপসেবল গেট আটকিয়ে আতঙ্কে থাকতেন খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই। দেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নব্বইয়ের দশক থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার সাধারণ মানুষ খুন হয়েছেন চরমপন্থিদের হাতে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক সদস্যকেও প্রাণ দিতে হয়েছে।
এমনই অচলাবস্থায় সাধারণ মানুষের মাঝে স্বস্তি ফেরাতে কাজ শুরু করে পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। একসময় বিভিন্ন চরমপন্থি গ্রুপের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় শুরু থেকেই নজরদারি বাড়ানো এবং চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে সংস্থাটি।
র্যাব সফল অভিযানের মাধ্যমে বিভিন্ন চরমপন্থি গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ অনেক সদস্যকেই গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসে। চরমপন্থিদের সৃষ্ট ত্রাসের রাজত্বের দুর্গ র্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানে ভেঙে পড়ে। শীর্ষস্থানীয় চরমপন্থিসহ বিভিন্ন চরমপন্থি দলের সদস্যরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। এতে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি।
এক পর্যায়ে র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রমাগত আভিযানিক প্রক্রিয়ার চাপ সইতে না পেরে চরমপন্থি দলগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ সদস্যরা অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণের সুযোগ খুঁজতে থাকেন। অপরাধ জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাওয়া এ চরমপন্থিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয় র্যাব।
চরমপন্থি নির্মূলে র্যাবের এ সৃষ্টিশীল ও সাহসী উদ্যোগ এরই মধ্যে নানা মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। র্যাবের আত্মসমর্পণের উদ্যোগ নেওয়ায় চরমপন্থিরা স্বাভাবিক পেশায় জীবিকা নির্বাহ করার সুযোগ পাবে, যাযাবর জীবন থেকে ফিরতে পারবে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে। পাশাপাশি তাদের নির্যাতন ও লুটতরাজের ভয়ে ওইসব এলাকার সাধারণ মানুষকেও আর ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতে হবে না। জনজীবনে ফিরবে স্বস্তি, শান্তি ও নিরাপত্তা।
এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ২১ মে সিরাজগঞ্জ স্টেডিয়ামে র্যাব-১২-এর তত্ত্বাবধানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুরসহ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন চরমপন্থি গোষ্ঠীর মোট ৩২৩ জন সদস্য প্রায় দুই শতাধিক অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করবেন।
র্যাব জানায়, এর আগে এসব চরমপন্থিরা দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, সশস্ত্র হামলা, হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। তাদের এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রত্যেকের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা। র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের কারণে তারা দীর্ঘদিন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইলেও গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে তা পারছিলেন না। এবার তারা আত্মসমর্পণের মাধ্যমে অপরাধ জীবন ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন। চরমপন্থিদের অপরাধ জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে ২০২০ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে র্যাব।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জাগো নিউজকে বলেন, অপরাধ দমনে র্যাবের কর্মপরিকল্পনা বহুমাত্রিক। চরমপন্থিদের আত্মসমর্পণ করিয়েই থেমে থাকেনি র্যাব। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সক্রিয় অংশগ্রহণে অপরাধীদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে সর্বদা তৎপর রয়েছে র্যাব ফোর্সেস। অপরাধ দমনে র্যাব শুধু আভিযানিক প্রক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। র্যাবের গবেষণা ও প্রশিক্ষণের আলোকে সৃষ্টিশীল ও সময়োপযোগী বিভিন্ন উদ্যোগ তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। যার প্রতিফলন ঘটেছে বিভিন্ন মানবিক ও সৃষ্টিশীল প্রকল্পের মাধ্যমে।
তিনি বলেন, এ পরিপ্রেক্ষিতে সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, বগুড়া, কুষ্টিয়া, পাবনা, মেহেরপুর, রাজবাড়ী জেলাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বহারা ও চরমপন্থিদের পরিবারের সদস্যদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে তাদের আর্থিকভাবে স্বচ্ছল করতে নানা কর্মমুখী প্রশিক্ষণ প্রদানসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতার মাধ্যমে সমাজে স্বাভাবিক পেশায় পুনর্বাসিত করা হবে। টাঙ্গাইলে ৩০টি সর্বহারা পরিবারের নারী সদস্যদের হস্তশিল্প প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করতে ‘উদয়ের পথে’ নামক পাইলট প্রোগ্রাম চলমান রয়েছে। ভূমিহীনদের স্থায়ী বাসস্থানের জন্য ভূমি বরাদ্দের পরিকল্পনা রয়েছে।
র্যাবের এ মিডিয়া উইং কর্মকর্তা আরও বলেন, বিভিন্ন চরমপন্থি দলের নেতা ও সদস্যদের আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে গরুর খামার, পোল্ট্রি ফার্ম, মাছ চাষের ব্যবস্থা, চায়ের দোকান, ভ্যান-রিকশা, সেলাই মেশিন দেওয়ার মাধ্যমে চরমপন্থি সদস্য ও তাদের পরিবারগুলোকে স্বাভাবিক পেশায় স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল করতে র্যাব শুধু অভিযান নয়; অপরাধীদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে এর আগে বিভিন্ন সময়ে কার্যকরী পন্থায় নানা মানবিক উদ্যোগও নিয়েছে। জঙ্গি দমনে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতির আলোকে কাজ করে যাচ্ছে র্যাব এবং জঙ্গি দমনে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল। শুধু গ্রেফতারের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ নির্মূল নয়, বরং আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া এবং পুনর্বাসনের মাধ্যমে পথভ্রষ্ট জঙ্গিদের সাধারণ জীবনে ফিরতে সহায়তা করছে র্যাব।
এর আগে ‘নবদিগন্তের পথে’ শীর্ষক র্যাবের ডি-রেডিক্যালাইজেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রায় অর্ধশতাধিক বিপথগামী জঙ্গি আত্মসমর্পণ করে সাধারণ জীবনে ফেরেন। আত্মসমর্পণ পরবর্তী তাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে র্যাব বিভিন্ন ধরনের (ট্রাক্টর, গবাদি পশু, ফার্মেসি) সহায়তা দিয়েছে। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকেও আত্মসমর্পণকারী জঙ্গিদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শন সুন্দরবন একসময় ছিল বনদস্যু ও জলদস্যুদের অভয়ারণ্য। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন দেশীয় ও বিদেশি শাসকরা সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু কেউই পারেননি। প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞা ও দিক-নির্দেশনা থেকে র্যাব সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া একে একে সুন্দরবন, কক্সবাজার, মহেশখালী ও বাঁশখালী অঞ্চলের ৫০টি বাহিনীর ৪০৫ জন জলদস্যু ৬৫০টি অস্ত্র এবং ৩২ হাজার ২০৭ রাউন্ড গোলাবারুদসহ র্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এ জলদস্যুদের নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। পাশাপাশি র্যাবের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উৎসবে তাদের উপহারসামগ্রী দেওয়া হচ্ছে।
এরই মধ্যে জলদস্যু পরিবারগুলোকে সাবলম্বী করতে ১০২টি ঘর, ৯০টি মালামালসহ মুদি দোকান, ২২৮টি গবাদি পশু, ১২টি মাছ ধরার নৌকা ও জাল এবং ৮টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা দেওয়া হয়েছে। ফলে সুন্দরবন অঞ্চলে এখন শান্তির সু-বাতাস বইছে। এছাড়া সুন্দরবন, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার আত্মসমর্পণ করা জলদস্যুদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত রয়েছে র্যাব।
এলিট ফোর্স র্যাব অপরাধ দমন এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো এবং সেই জীবন ধরে রাখা বা অপরাধ থেকে তাদের দূরে রাখার প্রয়াসে র্যাবের ‘নবজাগরণ’ কর্মসূচির স্লোগান হলো- ‘অপরাধকে না বলুন’। এ প্রকল্পের আওতায় সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝরে পড়াদের এবং বেকার ও স্বল্প আয়ের মানুষদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে কক্সবাজারে ৩৬ জন প্রশিক্ষণার্থীকে সেলাই, ড্রাইভিং, টুরিস্ট গাইড, ফটোগ্রাফি, রেস্টুরেন্ট সার্ভিস এবং সার্ফিং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া প্রশিক্ষণ চলাকালীন প্রশিক্ষণার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। নবজাগরণ কর্মসূচির মাধ্যমে পারিবারিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক অন্তরায় কাটিয়ে এলাকাভিত্তিক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যেন সমাজের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ অপরাধে না জড়ানোর বিষয়ে সচেতন থাকে।