ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে নানা কয়দায় চাঁদাবাজির পেছনে রয়েছে হাইওয়ে পুলিশ। মাসিক ভিত্তিতে দালাল ও লাইনম্যানদের মাধ্যমে চাঁদা তোলা ও বিলি-বণ্টন হয়। চাঁদার একটি বড় অংশ যায় অসৎ পুলিশ কর্মকর্তাদের পকেটে। প্রতিমাসে কোন পর্যায়ে পুলিশের কাছে কী পরিমাণ অর্থ যায় তার একটি গোপন তালিকা যুগান্তরের হাতে এসেছে। তা পর্যালোচনা করে দেখা যায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের নিষিদ্ধ গাড়ি, হাট-বাজার, স্ট্যান্ড ও দোকানপাট থেকে মাসে প্রায় ২০ লাখ টাকা হাইওয়ে পুলিশের পকেটে যায়। যাদের মাধ্যমে চাঁদা তোলা হয়, তালিকায় তাদের নাম এবং ফোন নম্বর রয়েছে। সেই লাইনম্যানদের কয়েকজনের সঙ্গে যুগান্তরের কথা হয়েছে। তারা চাঁদা তোলা বা দেওয়ার কথা স্বীকারও করেছেন। এছাড়া বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীও চাঁদা দেওয়ার কথা যুগান্তরকে জানিয়েছেন। তবে হাইওয়ে পুলিশ পরোক্ষ এই চাঁদাবাজির কথা অস্বীকার করেছে।
প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গাবতলী থেকে ধামরাই পর্যন্ত অংশে অবৈধ লেগুনা, থ্রি-হুইলার, বেডফুড ট্রাক, প্রাইভেটকার স্ট্যান্ড, অটোরিকশা ও সিএনজি স্ট্যান্ড, বাজার ও দোকানপাট থেকে মাসে ৮০ লাখ চাঁদা আদায় হয়। এর ২৫ শতাংশ পৌঁছে যায় হাইওয়ে থানায়। বাকি টাকা স্থানীয় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা চক্র ভাগবাটোয়ারা করে নেয়।
গাবতলী ও মিরপুর এলাকার দুই শতাধিক মেয়াদ উত্তীর্ণ ট্রাক (বেডফুট ট্রাক) চলাচল করে পুলিশকে চাঁদা দিয়ে। অভিযোগ রয়েছে আমজাদ হোসেন, ইসমাইল হোসেন ও মাসুম হাইওয়ে পুলিশকে মাসোহারা পৌঁছে দেন। এ ব্যাপারে আমজাদ হোসেন বলেন, ‘বেডফুট ট্রাকগুলোর কোন কাগজপত্র নেই। এগুলো চালাতে হয় হাইওয়ে পুলিশকে টাকা দিয়ে। আমার ১০-১২টি ট্রাক রয়েছে। প্রতিটিতে মাসে আড়াই হাজার করে টাকা দেই। কখনো ইউনুসের মাধ্যমে সাভার হাইওয়ে থানার ওসির কাছে টাকা পাঠিয়ে দিই। আবার কখনো ওসির দেওয়া বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠাই।’
যোগাযোগ করা হলে ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আগে আমার বেশ কয়েকটি ট্রাক ছিল। এখন আছে একটি। বাকিগুলো বিক্রি করে দিয়েছি। চাঁদা দিয়েই গাড়ি চালাতে হয়।’ সূত্র জানায়, আমজাদ, ইসমাইল ও মাসুম হাইওয়ে পুলিশকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা মাসোহারা দিয়ে বেডফুট ট্রাকের ব্যবসা পরিচালনা করেন। এছাড়া হেমায়েতপুর থেকে আশুলিয়া, চারাবাগ এবং বিরুলিয়া পর্যন্ত চার শতাধিক লেগুনা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ব্যবহার করে চলাচল করে। এসব লেগুনা থেকে প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়। এই হিসাবে দিনে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং মাসে ৩৬ লাখ টাকা চাঁদা ওঠে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন লেগুনা চালক বলেন, আগে চাঁদা দিতে হতো সাভার বাসস্ট্যান্ডে। এখন চাঁদা দেওয়ার স্থান পরিবর্তন হয়েছে। এখন চারাবাগ এলাকায় চাঁদা নেন নির্দিষ্ট লাইনম্যানরা। এই টাকা দিয়ে, হাইওয়ে পুলিশ এবং থানা পুলিশকে ম্যানেজ করা হয়।
আরও কয়েকজন লেগুনা চালক জানান, এই রোডের চাঁদার টাকা থেকে শুধু হাইওয়ে পুলিশ পায় ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। এই টাকা পৌঁছে দেওয়া হয় থানায়। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বলিয়ারপুর অটোস্ট্যান্ড থেকে মাসে লাখ চাঁদা তোলেন আবুল কাশেম। অভিযোগ রয়েছে, এই টাকা থেকে তিনি ৩০ হাজার টাকা পৌঁছে দেন হাইওয়ে থানায়। আবুল কাশেম বলেন, এখানে দেড়-দুইশ অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশা রয়েছে। দিনে প্রতিটি থেকে ২০ টাকা করে টাকা নেই। এই টাকা দিয়ে আমি চলি। পাশাপাশি অন্যান্য খরচও মেটাই।
ভাকুর্তা ভাঙা ব্রিজ এলাকায় চলাচলরত প্রাইভেট কার ও লেগুনা থেকে মাসে চাঁদা ওঠে প্রায় ২ লাখ টাকা। এছাড়া সাভার রানা প্লাজা প্রাইভেটকার স্ট্যান্ড, বিশমাইল এলাকার অটো, সিএনজি স্ট্যান্ড এবং অবৈধ দোকানপাট, কুরগাও এলাকার কাটা সিএনজি, নবীনগরের ফুটপাত, নয়ারহাট মাছের আড়ত, নবীনগর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবৈধ পার্কিং, ঢুলিভিটা সিএনজি স্ট্যান্ড, জয়পুরা সিএনজি স্ট্যান্ড, ঢুলিভিটা ব্রিজের নিচের উভয়পাশের অবৈধ পার্কিং, পল্লী বিদ্যুৎ কবরস্থান রোডের মাথায় সিএনজি স্ট্যান্ড, কাঁচাবাজার ও ফুটপাত, পলাশবাড়ি ট্রাকস্ট্যান্ড, বাইপাইল স্ট্যান্ড, ইপিজেড ট্রাকস্ট্যান্ড, ইপিজেড এলাকার ফুটপাত, শ্রীপুরের ফুটপাত, মাহিন্দ্র স্ট্যান্ড থেকে চাঁদা তোলা হয়। এসব স্পটে চাঁদার হার সর্বনিম্ন মাসে ৩০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা।
নবীনগর কুরগাঁ রোডের মাথা থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ফুটপাত হয়ে নিরিবিলি এলাকা পর্যন্ত মহাসড়কে প্রায় তিনশ ভ্রাম্যমাণ দোকান রয়েছে। ভুক্তভোগীরা জানান, মাসুদ নামে এক ব্যক্তি হাইওয়ে পুলিশের নামে চাঁদা তোলেন। প্রতি দোকান থেকে শুক্রবারে ১০০ টাকা এবং সপ্তাহের অন্যান্য দিন ৫০ টাকা এবং ভ্যান থেকে প্রতিদিন ১৫০ টাকা হারে টাকা তোলেন। এই ফুটপাত থেকে মাসে ৫ লক্ষাধিক টাকার চাঁদা ওঠে। মাসুদ সম্প্রতি সহযোগীসহ র্যাবের হাতে গ্রেফতার হলেও জামিনে বের হয়ে আবারও বেপরোয়া। মাসুদ বলেন, ‘হাইওয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করেই চাঁদা তোলা হয়।’
জাতীয় স্মৃতিসৌধের ২ নম্বর গেটের ফুটওভারব্রিজ এলাকা থেকে ধামরাইয়ের কাওয়ালিপাড়া পর্যন্ত ৫০টি লেগুনা চলাচল করে। এ লাইনের একাধিক লেগুনা চালক জানিয়েছেন, প্রতিদিন ৫০ টাকা করে তারা মাসে ৭৫ হাজার টাকা চাঁদা দেন নির্দিষ্ট লাইনম্যানকে। এছাড়া মালিকরা ৩ হাজার টাকার করে চাঁদা দেন। কাগজপত্র না থাকায় পুলিশকে ম্যানেজ করেই লেগুনা চালাতে হয়।
পল্লী বিদ্যুৎ কবরস্থান রোডের মাথা থেকে গাজীরচট বটতলা পর্যন্ত রুটে ৩০টি সিএনজি চলাচল করে। কবরস্থান রোডের মাথার একজন গ্যারেজ মালিক জানান, এই রুটে তার দুইটি সিএনজিও চলাচল করে। হাইওয়ে পুলিশের নামে প্রতি সিএনজি থেকে ১১শ টাকা চাঁদা নেন রাকিব। এ সম্পর্কে রাকিব যুগান্তরকে বলেন, ‘এই রুটে ২৭ হাজার টাকা ওঠে। এর মধ্যে সাভার হাইওয়ে থানায় দেই ১২ হাজার, আশুলিয়া থানায় ৩ হাজার এবং বাইপাইল ট্রাফিক বক্সে দিই ১২ হাজার টাকা।
পল্লী বিদ্যুৎ সিএনজি ও অটোস্ট্যান্ড এলাকায় ৪৭টি সিএনজি থেকে ৮শ করে টাকা তোলেন আবুল। এখন থেকে মাসে ৩৭ হাজার ৬শ টাকা তোলা হয়। তবে আবুল বলেন, ‘আমি আগে টাকা তুলতাম, এখন টাকা তুলে ফজলু। এই টাকা হাইওয়ে থানা, নবীনগর পুলিশ বক্স, বাইপাইল পুলিশ বক্স আর আশুলিয়া থানায় দেওয়া হয়।’
আশুলিয়া থানাধীন পল্লী বিদ্যুৎ বাসস্ট্যান্ড এলাকার ঢাকা-চন্দ্রা মহাসড়কের সার্ভিস লেনের একাংশ এবং ফুটপাত দখল করে গড়ে উঠেছে অবৈধ বাজার। এই বাজার ও ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলা হয়। আশুলিয়ার পলাশবাড়ী এলাকায় ঢাকা-চন্দ্রা মহাসড়কের পাশে গড়ে উঠা ট্রাক স্ট্যান্ডে আগে টাকা তুলতেন টিটু। তবে টিটুর দাবি এখন টাকা তুলেন এছহাক। যোগাযোগের চেষ্টা করেও এছহাককে পাওয়া যায়নি। তবে এছহাকের সহযোগী আমজাদ বলেন, এই স্ট্যান্ডে একটি ট্রাক ১২ ঘণ্টা পার্কিংয়ের বিনিময় ১০০ টাকা নেওয়া হয়। এছাড়া ৩০টি ট্রাক থেকে মাসে ২ হাজার করে ৬০ হাজার টাকা তোলা হয়।
এদিকে ব্যাটারি রিকশাচালকরা অভিযোগ করেন, তাদের রিকশা মহাসড়কের আওতার বাইরে থাকলেও আটক করে হাইওয়ে পুলিশ। এরপর ২৬০০ টাকা রেকার বিল নিয়ে ছেড়ে দেয়। কিন্তু তাদেরকে রেকার বিলের কোনো রসিদ দেওয়া হয় না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাভার হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল হক যোগদানের পর থেকেই সড়কের এসব খাত থেকে চাঁদাবাজি বেড়ে গেছে। তিনি এর আগেও ঢাকা জেলার বিভিন্ন থানায় চাকরি করেছেন। যে কারণে এই এলাকার বিভিন্ন খাত তার নখদর্পণে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আজিজুল হক বলেন, ‘এসব অভিযোগ সঠিক নয়। আমরা অবৈধ যানবাহন, হাটবাজারের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করি।’ কিন্তু মহাসড়কের অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করা যাচ্ছে না কেন-এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি তিনি। আর আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসএম কামরুজ্জামান বলেন, ‘হাইওয়েতে যেসব অবৈধ গাড়ি চলাচল করে, সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব হাইওয়ে পুলিশ ও ট্রাফিকের।’ কিন্তু হাইওয়ে ছাড়া আশুলিয়ার অন্যান্য সড়কে চলা অবৈধ যানবাহন বন্ধ করা যাচ্ছে না কেন?-এই প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে পারেননি।