নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সিন্ডিকেটকে ধরতে এবং সম্পৃক্তদের লুটপাট করা সম্পদের খোঁজে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি কমিশন থেকে এ বিষয়ে একটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দ্রুত সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান টিম গঠন করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে বলে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি মাউশির ৫১৩টি পদে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় এরই মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) শিক্ষা কর্মকর্তা চন্দ্র শেখর হালদারসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ এ বিষয়ে তাদের মতো তদন্ত করছে। দুদকের কাছেও তথ্য রয়েছে যে প্রশ্নফাঁস ও নিয়োগ বাণিজ্য চক্রের সঙ্গে মাউশির অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। যেখানে চন্দ্র শেখর হালদার ও উচ্চমান সহকারী নাজমুল হোসেনসহ আট থেকে ১০ জনের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দুদকের অভিযানে স্কুলের বিভিন্ন নিয়োগের ক্ষেত্রেও অনিয়মের সত্যতা পাওয়া গেছে। সে বিষয়েও আমাদের কাজ চলছে। ওই সিন্ডিকেটের প্রধান ও সদস্যদের আটক করা, শাস্তি দেওয়া ও নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করাই দুদকের প্রধান উদ্দেশ্য।
দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত ও নিয়োগ বাণিজ্য, অবৈধ এমপিওভুক্তি, বদলি বাণিজ্য সিন্ডিকেটের ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে মাউশির এক কর্মকর্তা দুদকে অভিযোগ দাখিল করেন। যার ভিত্তিতে দুদকের গোয়েন্দা বিভাগ যাচাই-বাছাই করে মাঠে নেমেছে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ বদলি ও এমপিওভুক্তি, পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিবেদন দেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে সম্পৃক্ত। যে ঘটনায় এরই মধ্যে শিক্ষা কর্মকর্তা চন্দ্র শেখর হালদার, মাউশি কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও উচ্চমান সহকারী মো. বিল্লাল হোসেন ও নাজমুল হোসেনের নাম বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তারা বদলি, নিয়োগ বাণিজ্য, পদোন্নতি, দুর্নীতির মাধ্যমে এমপিওভুক্তির সঙ্গে জড়িত। তাদের সঙ্গে সিন্ডিকেটের ইএমআইএস সেলের কর্মকর্তারাও রয়েছেন।
২০২২ সালের ১৩ মে মাউশির কম্পিউটার অপারেটরের ৫১৩টি পদে নিয়োগের জন্য লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষা চলাকালে প্রশ্নফাঁসের খবর বের হয়। এরপর ইডেন কলেজ কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্রের উত্তরসহ চাকরিপ্রার্থী সুমন জোয়ার্দার নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার প্রবেশপত্রের উল্টো পিঠে ৭০টি এমসিকিউ প্রশ্নের উত্তর লেখা ছিল। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পটুয়াখালীর খেপুপাড়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। সুমন ও সাইফুলকে এক দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে তারা পরীক্ষার আগেই প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি স্বীকার করেন। পরে নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করে মাউশি।
প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষক আবদুল খালেক বাদী হয়ে রাজধানীর লালবাগ থানায় মামলা করেন। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পরীক্ষা শুরু হয় বিকেল ৩টায়। পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সুমন জোয়ার্দার জানান, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে দুপুর ২টা ১৮ মিনিটে তার মোবাইলে পটুয়াখালীর সাইফুল ও টাঙ্গাইলের খোকন উত্তরপত্র পাঠান।
এ তথ্যের ভিত্তিতে ১৪ মে পটুয়াখালী সরকারি কলেজের প্রভাষক রাশেদুল, মাউশির উচ্চমান সহকারী আহসান হাবীব ও অফিস সহকারী নওশাদকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে মূল পরিকল্পনাকারী হিসাবে মাউশি কর্মকর্তা চন্দ্র শেখর হালদার ওরফে মিল্টনের নাম উঠে আসে। তিনিই ওই নিয়োগ পরীক্ষার ইডেন কলেজ কেন্দ্র সমন্বয় করার দায়িত্বে ছিলেন। যার ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের ২৫ জুলাই মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রধান চন্দ্র শেখর হালদারকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। রাজধানীর সেগুনবাগিচা থেকে তেজগাঁও ডিবির একটি দল গ্রেপ্তার করে ৩১তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের এ কর্মকর্তাকে।
মাউশি সূত্রে জানা যায়, মাউশির বিভিন্ন পদে ৫১৩ জন নিয়োগের বিপরীতে চাকরি প্রার্থী ছিলেন এক লাখ ৮৩ হাজার জন। পদ অনুসারে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকায় লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করার চুক্তি হয়েছিল। যেখানে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এমন সিন্ডিকেট সক্রিয় ছিল বলে জানা গেছে।
মাউশির ৪ হাজার কর্মচারী নিয়োগেও ঘাপলা
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের অধীন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজে চার হাজার কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে সহকারী পরিচালক জেসমিন আক্তার ও রনজিৎ কুমার কর্মকারের সমন্বয়ে গঠিত একটি টিম মাউশি কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করে। ওই অভিযানেও সিন্ডিকেটের নীরব উপস্থিতির প্রমাণ মেলে।
নিয়োগবিধি ১৯৯১ অনুযায়ী প্রথমে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের জন্য পদক্ষেপ নিলেও পরে শুধু ৭০ নম্বরের এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া হয়। নিয়োগ নোটিশে দশম গ্রেডের পদগুলো দ্বিতীয় শ্রেণি উল্লেখ করা হলেও মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ অনুমোদনের ক্ষেত্রে তা তৃতীয় শ্রেণি দেখিয়ে অনুমোদন নেওয়া হয় এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের অক্টোবরে ২৮টি পদের বিপরীতে চার হাজার ৩২ জনকে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয় মাউশি। এতে আবেদন করেন আট লাখ ৯৭ হাজার ৪৯ জন। এরই মধ্যে বেশির ভাগ পদের এমসিকিউ পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ওই নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক মাউশির কলেজ ও প্রশাসন শাখার পরিচালক অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী ও সদস্য সচিব ছিলেন উপপরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) মো. রুহুল মোমিন। সম্প্রতি নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে।
অভিযানের বিষয়টি নিশ্চিত করে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মদ আরিফ সাদেক বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক চার হাজার কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মাউশি কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। দুদক টিম অভিযোগ যাচাই ও সত্যতা উদঘাটনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেন এবং সংশ্লিষ্ট অভিযোগ সম্পর্কে তার বক্তব্যও রেকর্ড করেন।
সূত্র জানায়, সরকারি কলেজে ১০টি বিষয়ের প্রদর্শক, গবেষণা সহকারী, সহকারী গ্রন্থাগারিক কাম ক্যাটালগার, ল্যাবরেটরি সহকারীর পদগুলো দশম গ্রেডের। এ ধরনের ৬১০টি পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। সরকারি বিধিমালা অনুযায়ী, দশম থেকে দ্বাদশ গ্রেড পর্যন্ত দ্বিতীয় শ্রেণির পদ।
মাউশির নিয়োগবিধিতে পদগুলো তৃতীয় শ্রেণির দেখিয়ে শুধু এমসিকিউ পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়। অন্যান্য পদের মধ্যে ২০তম গ্রেডের অফিস সহায়ক, নিরাপত্তা প্রহরী, মালি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং ১৬তম গ্রেডের অফিস সহকারী, হিসাব সহকারী, ক্যাশিয়ার, স্টোর কিপার, গাড়িচালকসহ আরও কিছু পদের সবারই এমসিকিউ পরীক্ষা নেওয়া হয়।
মাউশির প্রশ্নফাঁস ও নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।