ঈদুল ফিতরের আগে-পরে ১৪ দিনে (১৬ এপ্রিল থেকে ২৯ এপ্রিল) দেশে ২৪০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৮৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৪৫৪ জন। এর মধ্যে ১২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৩৩ জন, যা মোট নিহতের ৪৬.৬৬ শতাংশ।
এছাড়াও এই সময়ে ৫টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৮ জন নিহত ও ২ জন নিখোঁজ রয়েছেন। ১১টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত এবং ৬১ জন আহত হয়েছেন।
মঙ্গলবার (২ মে) দুপুরে সংবাদ মাধ্যমে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমানের পাঠানো এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়- মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ১৩৩ জন; বাস যাত্রী ৯ জন; ট্রাক-পিকআপ-ট্রলি আরোহী ১৫ জন; প্রাইভেটকার আরোহী ২ জন; থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা) ৫১ জন; স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-চাঁন্দের গাড়ি- টমটম-লাটাহাম্বা) ১০ জন এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল আরোহী ১৩ জন নিহত হয়েছেন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৩৬.৬৬ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৩৪.৫৮ শতাংশ আঞ্চলিক সড়কে, ১৭.৯১ শতাংশ গ্রামীণ সড়কে এবং ১০.৮৩ শতাংশ শহরের সড়কে সংঘটিত হয়েছে।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ধরন ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ
ঈদুল ফিতর উদযাপনকালে ১২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৩৩ জন, যা মোট নিহতের ৪৬.৬৬ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৫২.৯১ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ধরণ বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫৫.১১ শতাংশ, মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছে ২১.২৫ শতাংশ, অন্য যানবাহনের মাধ্যমে মোটরসাইকেলে ধাক্কা/চাপায় দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৩.৬২ শতাংশ।
উল্লেখ্য, বেপরোয়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় ১৬ জন পথচারী নিহত হয়েছেন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আক্রান্তদের মধ্যে ৫১ শতাংশ ১৩ থেকে ২০ বছর বয়সী।
২০২২ সালের ঈদুল ফিতর উদযাপনের সময় ১২৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৬ জন নিহত হয়েছিল। এই হিসাবে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি কমেছে ১৪.৭৪ শতাংশ।
ঈদযাত্রা ও দুর্ঘটনা পর্যালোচনায় বলা হয়, এবারের ঈদুল ফিতরে রাজধানী ঢাকা থেকে কমবেশি ১ কোটি মানুষ ঘরমুখী যাত্রা করেছে এবং দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৪ কোটি মানুষ যাতায়াত করেছে। ঈদের আগে-পরে যথেষ্ট ছুটি থাকা, পদ্মা সেতু চালু হওয়া, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক কয়েকটি ওভারপাস-সহ ফোর লেন হওয়া, দেশের বিভিন্ন সড়কের অবস্থা ভালো থাকা, বৃষ্টিপাত না হওয়া এবং সরকারের বাড়তি তৎপরতা থাকা ইত্যাদি কারণে ঈদযাত্রা তুলনামূলক স্বস্তিদায়ক ছিল। কোথাও তেমন অসহনীয় যানজট হয়নি। দুর্ঘটনাও অনেকটা কম ঘটেছে। গত বছর ঈদুল ফিতর উদযাপনের সময় ২৮৩টি দুর্ঘটনায় ৩৭৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। এই হিসাবে এবছরের ঈদুল ফিতরে দুর্ঘটনা কমেছে ১৫.১৯ শতাংশ এবং প্রাণহানি কমেছে ২৪.২০ শতাংশ।
তবে ট্রেনের টিকিট শতভাগ অনলাইন করায় টিকিট সংগ্রহ করতে মানুষের ভোগান্তি হয়েছে। ঈদে ঘরমুখী যাত্রার চেয়ে ফিরতি যাত্রায় যানবাহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়েছে। যেটা মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি।
ঈদযাত্রায় ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে’তে ৭টি দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়েছে। সবগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে অতিরিক্ত গতির কারণে। যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নেই।
ঈদযাত্রায় মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচলে বিধি-নিষেধ না থাকা এবং পদ্মা সেতুতে গতি নিয়ন্ত্রণ ও লেন মানার শর্ত সাপেক্ষে মোটরসাইকেল চলাচলের সুযোগ থাকার কারণে সবগুলো মহাসড়ক ধরে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ মানুষ মোটরসাইকেলে গন্তব্যে ফিরেছে। ফলে বাস ও ট্রেনের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়েনি। উল্লেখ্য, মানসম্পন্ন গণপরিবহন সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী না হওয়ার কারণেই মানুষ মোটরসাইকেলে দূরের গন্তব্যে যাতায়াত করছে। এটা উদ্বেগের বিষয়। কারণ মোটরসাইকেল ৪ চাকার যানবাহনের চেয়ে ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই মোটরসাইকেল কোনোভাবেই গণপরিবহনের বিকল্প হতে পারে না।
ঈদের পরের দিন ২৩ এপ্রিল ফেনী সদর উপজেলায় শাহীন নামে ৩৮ বছর বয়সী এক দরিদ্র ব্যক্তি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে স্থানীয়, চট্টগ্রাম ও ঢাকার কোনো সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ চিকিৎসা সেবা না পেয়ে বাড়ি ফিরে মৃত্যুবরণ করেছেন। এই নির্মম ঘটনা আমাদের সামনে দু’টি চিত্র তুলে ধরছে। এক- দেশে দরিদ্র মানুষের আধুনিক চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ খুবই কম। দুই- মোটরসাইকেল চালকদের মানসম্পন্ন হেলমেট ক্যবহার না করা। এসব বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
ঈদ উদযাপনের সময় সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যাপক সংখ্যক মানুষ আহত হয়েছে। বাস্তবতা হলো, যেসব দুর্ঘটনায় শুধু আহত হয়েছে, বা পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে, সেসব দুর্ঘটনার খবর অধিকাংশই গণমাধ্যমে আসেনি। ফলে দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের প্রকৃত চিত্র জানা যাচ্ছে না। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে যে সংখ্যক মানুষ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালসহ ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসা নিয়েছে এবং নিচ্ছে তা থেকে অনুমান করা যায়, এবারের ঈদুল ফিতর উদযাপনের সময় কয়েক হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে।
কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পড়ছেন এবং অন্যদের আক্রান্ত করছেন। অপ্রাপ্ত বয়স্করা যাতে মোটরসাইকেল চালাতে না পারে সেজন্য কঠোর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা-সহ এ বিষয়ে পারিবারিক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য গণমাধ্যমে প্রচারণা চালানো প্রয়োজন। মোটরসাইকেল উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই প্রচারণার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। মোটরসাইকেল বাজারজাতকরণে উচ্ছৃঙ্খল ভাষাভঙ্গিতে চটকদার বিজ্ঞাপন নির্মাণ ও প্রচার বন্ধ করতে হবে। কারণ কিশোর-যুবকরা এসব বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মোটরসাইকেলে গতির প্রতিযোগিতা করতে উৎসাহিত হচ্ছে। সরকারের উচিত গণপরিবহন উন্নত, সহজ ও সাশ্রয়ী করে এবং রাজধানীর যানজট নিয়ন্ত্রণ করে মোটরসাইকেল নিরুৎসাহিত করা।
মোটরসাইকেল উৎপাদন ও আমদানির ক্ষেত্রে সরকার নানা প্রকার সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। ফলে দেশে মোটরসাইকেলের ব্যবহার ব্যাপকহারে বাড়ছে। এটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। বছরে ৫ হাজার কোটি টাকার মোটরসাইকেলের ব্যবসা করতে যেয়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার মানব সম্পদ হারিয়ে যাচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলো– ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; বেপরোয়া গতি; চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
দুর্ঘটনারোধে সুপারিশগুলো হচ্ছে- দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য সার্ভিস রোড তৈরি করতে হবে; পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে; গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; রেল ও নৌ-পথ সংস্কার করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমাতে হবে; গণপরিবহন উন্নত, সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করে মোটসাইকেল ব্যবহার নিরৎসাহিত করতে হবে; ঈদের আগে-পরে সড়ক, নৌ ও রেলপথে কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে; টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।