অস্ত গেছে বছরের শেষ সূর্য। রাত পোহালেই বাংলা পঞ্জিকায় যোগ হবে নতুন বছর ১৪৩০। বাঙালি মেতে উঠবে প্রাণের উৎসবে। ভোর থেকে শুরু হওয়া আনুষ্ঠানিকতা চলবে দিনভর। যার প্রধান অনুষঙ্গ রমনার বটমূলে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের আয়োজন আর চারুকলা ইনস্টিটিউটের বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা। সব গ্লানি, জরার অবসানে অগ্নিস্নানে ধরা হবে শুচি, বয়ে আনবে কল্যাণ। এই কামনাই থাকবে দিনটিতে।
বাঙালির সার্বজনীন এই উৎসব বাঙালির মধ্য শত বছরের লোকজ ঐতিহ্যের কথা জানান দেয় প্রভাতী অনুষ্ঠানমালা আর বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা বাড়তি মাত্রা যোগ করে বর্ষবরণের এই আয়োজনে।
প্রতি বছরের মতো এবারও বাংলা নতুন বছরকে বরণ করতে প্রস্তুত সারাদেশ। প্রস্তুত রাজধানী ঢাকাও। দেশজুড়ে এখন শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। নতুন বছরকে বরণ করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউট ছাড়াও সব বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে চলছে উৎসবের আমেজ।
বর্ষবরণে দেশের সবচেয়ে বড় আয়োজনটা থাকে রাজধানীর রমনা বটমূলে। গানে গানে নতুন বছরকে আমন্ত্রণ জানায় ছায়ানট। সকালে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা।
১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর বাংলা বর্ষের প্রবর্তন করেছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর। প্রজাদের খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে সম্রাট আকবরের আমলে ইংরেজি ও আরবি সনের পাশাপাশি নতুন বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। সম্রাটের নির্দেশে তৎকালীন বিখ্যাত চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজী ফসল তোলা ও খাজনা আদায়ের সময় বিবেচনায় রেখে এই নতুন সনের নিয়ম প্রবর্তন করেছিলেন।
শুরুতে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন। মুঘল সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের দিন থেকে এই সনের গণনা কার্যকর হয়। এদেশের প্রকৃতি ও মানুষের জীবন চারণ কেন্দ্রিক হওয়ায় ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে মানুষ একে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে। কালক্রমে সেই ফসলি সনই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ হিসেবে পরিচিতি পায়।
সম্রাটের সময়ে মানুষদের চৈত্রের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা শোধ করতে হতো। পরের দিন পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টিমুখ করাতো। বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। সেসময়ের পহেলা বৈশাখে প্রধান ঘটনা ছিল একটি নতুন হিসাব বই বা হালখাতা তৈরি করা। তারপরে ক্রমে ক্রমে নববর্ষ বাঙালির সামাজিক অনুষ্ঠানের রূপ নেয়। বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়।
বর্ষবরণে নানা আয়োজন
বাংলা নববর্ষের প্রধান অনুষঙ্গ রমনা বটমূলে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের আয়োজন। আলোর সন্ধান পেতে হাল না ছাড়ার আহ্বান জানিয়ে এবার রমনার বটমূলে বর্ষবরণ উদযাপন করবে ছায়ানট।
গত সোমবার ঢাকার ধানমণ্ডিতে ছায়ানট মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে নববর্ষের আয়োজনের বিষয়ে জানাতে গিয়ে ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা জানান, বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মাস দুয়েক আগে থেকেই গান তোলা আর গলা মেলানোর কাজে শতাধিক ক্ষুদে ও বড় শিল্পী নেমেছে। ইতোমধ্যে মঞ্চ তৈরি হয়ে গেছে, যেখানে শ’দেড়েক শিল্পী-কর্মী থাকবেন।
লাইসা আহমদ বলেন, ‘গোটা অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছে নতুন স্নিগ্ধ আলোয় স্নাত প্রকৃতির গান, মানবপ্রেম-দেশপ্রেম আর আত্মবোধন- জাগরণের সুরবাণী দিয়ে। এবারের নববর্ষের প্রথম প্রভাতে, সত্য-সুন্দরকে পাওয়ার অভিলাষী ছায়ানটের আহ্বান, ‘দূর করো অতীতের সকল আবর্জনা, ধর নির্ভয় গান’।
বর্ষবরণের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ মঙ্গল শোভাযাত্রা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করবে। এছাড়া দেশের সব জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে বৈশাখী শোভাযাত্রা আয়োজন করা হবে। তাছাড়া রচনা প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও লোকজ মেলার আয়োজন করবে স্থানীয় প্রশাসন।
শিল্পকলা একাডেমি দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে। বাংলা একাডেমি ও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এবং বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন নিজেদের কার্যালয়ের সামনে নববর্ষ মেলা, আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।
এছাড়া শিশু একাডেমি, গণগ্রন্থাগার অধিদফতর, আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদফতর, জাতীয় জাদুঘর, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, কপিরাইট অফিস ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আলোচনাসভা, প্রদর্শনী, কুইজ, রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।
নববর্ষ ঘিরে ব্যাপক নিরাপত্তা
বাঙালির প্রাণের এই উৎসবকে ঘিরে র্যাপক নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হবে রমনা পার্কসহ পুরো রাজধানী।
শুধু রাজধানী ঢাকাই নয়, নববর্ষ ঘিরে সারাদেশেই নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, গোয়েন্দা সংস্থা ও তাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যৌথভাবে কাজ করবে। সার্বিক নিরাপত্তা ও নজরদারি নিশ্চিত করতে বসানো হয়েছে কন্ট্রোল রুম, অবজারভেশন পোস্ট ও চেক পোস্ট। আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি থাকছে গোয়েন্দা দলের সদস্য, বোমা ডিসপোজাল টিম ও মেডিক্যাল টিম।
পয়লা বৈশাখে শুধু ঢাকা মহানগরীতেই নিরাপত্তায় ২ হাজার ৭০০ পুলিশ মোতায়েন থাকবে বলে জানিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। তিনি বলেছেন, পয়লা বৈশাখে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে পয়লা বৈশাখে শুধু ঢাকা মহানগরীতেই নিরাপত্তায় ২ হাজার ৭০০ পুলিশ মোতায়েন করা হবে।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, রাজধানীর টিএসসি, শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও রমনাসহ যেসব এলাকায় বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হবে, সেসব এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টহল চেকপোস্ট ছাড়াও অবজারভেশন পোস্টসহ বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।