করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। আক্রান্তদের মধ্যে গুরুতর অসুস্থদের জন্য হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) ব্যবস্থা না থাকায় অনেককে হাসপাতালের বাইরে অ্যাম্বুলেন্সেও চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে। প্রয়োজন হচ্ছে অতিরিক্ত ক্লিনিক্যাল অক্সিজেনের। এতে বাড়ছে চাহিদা। আর তা পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছেন অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রেতা ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
বুধবার (১৪ এপ্রিল) রাজধানীর তেজগাঁওয়ের কলোনি বাজার, খিলগাঁও এবং সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের উল্টো পাশের অক্সিজেন সিলিন্ডারের দোকান ঘুরে দেখা যায়, ক্লিনিক্যাল অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনতে আসা গ্রাহকরা ফিরে যাচ্ছেন খালি হাতে। যারা রিফিল করতে আসছেন, তাদেরও করতে হচ্ছে অপেক্ষা।
দোকানিরা বলছেন, চাহিদা থাকলেও নতুন করে অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ইতোমধ্যে যাদের কাছে আমরা অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি করেছি, তাদেরই পরিপূর্ণভাবে রিফিল অক্সিজেন সিলিন্ডার দিতে পারছি না। নতুন করে বিক্রি করে আর ঝামেলায় জড়াতে চাই না।
অন্যদিকে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, হঠাৎ সিলিন্ডার অক্সিজেনের চাহিদা অনেক বেড়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান থেকে দিনে যে পরিমাণ অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব, তার বেশি কোনোভাবেই দেওয়া যাচ্ছে না। রিফিল অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাহিদাও অনেক বেড়ে গেছে।
ক্লিনিক্যাল অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রয় প্রতিষ্ঠান লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেডের তথ্যমতে, ওয়ান টু ওয়ান কাস্টমারের কাছে একটি পূর্ণাঙ্গ সিলিন্ডার সেট বিক্রি করা হচ্ছে ২৬ হাজার ৫২২ টাকায়। যেখানে থাকছে ১ দশমিক ৪ কিউবিক মিটার (১ হাজার ৪০০ লিটার) ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সিলিন্ডার, একটি অক্সিথেরাপি সেট, ফেস মাস্ক, নাসাল ক্যানোলা, সিলিন্ডার ট্রলি এবং অক্সিজেন গ্যাস রিফিল চার্জ। এই সিলিন্ডারে থাকা অক্সিজেন দিয়ে প্রতি মিনিটে দুই লিটার হিসেবে ১০ থেকে ১১ ঘণ্টা টানা ব্যবহার করা যাবে।
তবে বাজারে একই পরিমাপের অক্সিজেন সিলিন্ডার সেট ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। আর ৯ দশমিক ৮ কিউবিক মিটার (৯ হাজার ৮০০ লিটার) ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সিলিন্ডার সেট ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে সে ক্ষেত্রে দেওয়া হচ্ছে চায়না থেকে আমদানি করা সিলিন্ডার।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের উল্টো পাশের মিজান সার্জিক্যাল স্টোরের স্বত্বাধিকার ইসমাইল হোসেন বলেন, এখন অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাহিদা অনেক বেশি। কিন্তু বেশি থাকলেও আমরা অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি করা বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ আগে যাদের কাছে বিক্রি করেছি তাদেরই রিফিল দিতে পারছি না। নতুন করে বিক্রির চেয়ে রিফিল দেওয়াটাই জরুরি আমাদের কাছে। একটি সিলিন্ডার বিক্রির বিপরীতে অন্তত দুটি সিলিন্ডার আমাদের রিজার্ভ রাখতে হয়। কারণ ক্রেতা দুই ঘণ্টা পরেও আসতে পারেন, আবার পাঁচ ঘণ্টা পরেও আসতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, আগে কোম্পানি আমাদের সিলিন্ডার রিফিল করে দিয়ে যেত প্রতিদিনই। কিন্তু গত সাতদিনে রিফিল সংকটে পড়ে গেছি। এক ট্রাক সিলিন্ডার রিফিল করতে পাঠালে সেগুলো আসে এক থেকে দুই দিন পরে। কারণ চাহিদা বেশি হওয়ায় কোম্পানিতে ট্রাকের সিরিয়াল পড়ে গেছে। যার ট্রাক আগে যায়, তাকেই আগে রিফিল দিয়ে ফেরত পাঠাচ্ছে তারা।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ের কলোনি বাজার এলাকার মেসার্স তাহের এন্টারপ্রাইজের দোকানি জানান, এবার অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে তেমন কোনো অসুবিধা নেই। তবে অক্সিজেন ফ্যাক্টরি সিলিন্ডার রিফিল দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। এখন ডিলারের চেয়ে কোম্পানিতে সিলিন্ডারের চাহিদা বেশি বেড়েছে বলেও জানান তিনি।
কোম্পানিতে বেশ কিছু দিন ধরে অক্সিজেন সিলিন্ডার রিফিলের চাপ ব্যাপক বেড়েছে বলে জানালেন ইসলাম অক্সিজেন প্রাইভেট লিমিটেডের ডেপুটি ম্যানেজার মো. ইয়াকুব। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্লিনিক্যাল অক্সিজেন সিলিন্ডার রিফিলের চাপ এখন অনেক। সব সময় সিরিয়াল লেগে আছে। কারণ ৯ দশমিক ৮ কিউবিক মিটার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন একটা সিলিন্ডার স্কেলিং করতে ৫০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা সময় লাগে। আমাদের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। যেহেতু এটা আনলিমিটেড না। আমরা দিনে সর্বোচ্চ ২৮ হাজার ৮৮০ কিউবিক মিটার অক্সিজেন রিফিল করতে পারি।
স্পেক্ট্রা অক্সিজেন লিমিটেডের ঢাকা ডিপোর ডিসট্রিবিউশন অফিসার গৌতমও অক্সিজেন সিলিন্ডার রিফিলের চাপ বাড়ার কথা জানিয়েছেন। এদিকে করোনার সংক্রমণ রুখতে সরকার দেশে কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছে। ১৪ এপ্রিল থেকে এই বিধিনিষেধ কার্যকর হয়েছে। এর আগে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গত ৫ এপ্রিল থেকে সাতদিনের জন্য গণপরিবহন বন্ধসহ মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণে ১১ দফা কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সরকার। দুদিন পরে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে সকাল-সন্ধ্যা গণপরিবহন চলার অনুমতি দেওয়া হয়। এর একদিন পর খুলে দেওয়া হয় শপিংমলও। এতে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা নিয়ে সমালোচনা করেন বিশেষজ্ঞরা।
এরই মধ্যে করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই বাড়তে থাকে। প্রতিদিন মৃত্যু ও সংক্রমণের নতুন রেকর্ড হচ্ছে দেশে। এ পরিস্থিতিতে জাতীয় সংসদে দেওয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন ‘প্রয়োজনে আরও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার’। এরপর গত ৯ এপ্রিল সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ১৪ এপ্রিল থেকে ‘কঠোর ও সর্বাত্মক লকডাউন’ দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেন। পরে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীও একই ইঙ্গিত দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১২ এপ্রিল ১৩ দফা নির্দেশনা দিয়ে ১৪ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার।