মেহেরপুরে আতঙ্কের নাম আর্সেনিক। জেলার ১৩টি গ্রামের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে পান করে আসছেন এ আর্সেনিকযুক্ত পানি। হাতের নাগালে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিনিয়ত জেনেশুনেই এ বিষ পান করে চলেছে জেলার মানুষ। জেলার অধিকাংশ টিউবওয়েলের পানিতে ভয়াবহ মাত্রায় পাওয়া যাচ্ছে আর্সেনিক।
বিভিন্ন সংস্থা একাধিকবার কয়েকটি গভীর নলকূপ স্থাপন করলেও সেগুলো নষ্ট হওয়ায় বাধ্য হয়ে আর্সেনিকযুক্ত টিউবওয়েলের পানি পান করছেন এলাকাবাসী। তবে কতটি টিউবওয়েলে আর্সেনিক পাওয়া গেছে তা গণনার কাজ চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছে মেহেরপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।
সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা সদর উপজেলার আলমপুর গ্রামে। আর্সেনিক আতঙ্কে দিশেহারা স্থানীয়রা। এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের অস্থিত্ব পাওয়া গেছে সদর উপজেলার স্টেডিয়ামপাড়ার আমঝুপি, বেলতলাপাড়া, বুড়িপোতা, উজলপুর ও সুবিদপুরে। এদিকে, গাংনী উপজেলার ভোলাডাঙ্গা, মানিকদিয়া, সহগুলপুর ও তেঁতুলবাড়িয়া গ্রাম, মুজিবনগর উপজেলার তারানগর ও জয়পুর গ্রামের টিউবওয়েলের পানিতেও পাওয়া গেছে আর্সেনিক। নিরাপদ পানি না পেয়ে অনেকটা নিরুপায় হয়েই বছরের পর বছর আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করায় আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ওইসব গ্রামের শত শত মানুষ। ওই সমস্ত গ্রামের পানিতে ৩০০ পিপিবি মাত্রার আর্সেনিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলছেন চিকিৎসকরা।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন জেলার শতাধিক মানুষ। এছাড়া আক্রান্ত হয়েছেন দুই হাজারের বেশি মানুষ। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে কিছু কিছু রিং টিউবওয়েল, কয়েকটি এনজিও থেকে নিরাপদ পানির প্লান্ট স্থাপন করা হলেও সেগুলোর বেশিরভাগই অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে।
সদর উপজেলার আলমপুর দক্ষিণপাড়ার গৃহবধূ সাবিনা ইয়াসমিন জানান, গ্রামবাসী আর্সেনিকে আক্রান্ত হওয়ায় পাশের কোনো গ্রামের মানুষ তাদের সঙ্গে মেলামেশা কিংবা আত্মীয়তাও করতে চায় না।
একই গ্রামের সোনাভানু জানান, প্রথমে তার পায়ে চুলকানি ও ফুসকা পড়ে। ধীরে ধীরে সেখানে ক্ষত তৈরি হয়। পড়ে হাসপাতালে গেলে আর্সেনিক ধরা পড়ে। আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে তার একটি পা কেটেও ফেলতে হয়েছে। সোনাভানু এখন চলাফেরা করেন লাঠিতে ভর করে।
স্থানীয় আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা এ দেশের নাগরিক। তাই সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার আমাদেরও আছে। সরকার দ্রুত আমাদের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করবে এটাই প্রত্যাশা। অন্যথায় গ্রামের সব মানুষকে এ রোগে আক্রান্ত হতে হবে।
আলমপুর গ্রামের আবুল কালাম বলেন, আমার পরিবারের সাতজন সদস্য আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। সরকারিভাবে কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাইনি। আমরা বাঁচতে চাই। অনেক আগে থেকেই এলাকার মানুষ আর্সেনিকে আক্রান্ত। অনেক এনজিও গভীর নলকূপ স্থাপন করেছিল। সেগুলোও নষ্ট হয়েছে। বারবার জনস্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করলেও তারা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
এ বিষয়ে শ্রামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান জানান, টিউবওয়েলের পানি পান করে আর্সেনিক থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। সরকারিভাবে পানির প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে সকলকে সুপেয় পানি সরবরাহ করা হলে আর্সেনিক থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। আমরা এই পানির প্লান্ট স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। তবে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা থাকলেও মৃতের কোনো পরিসংখ্যান নেই। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় আর্সেনিকোসিস রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৭৯ জন। এরমধ্যে সদর উপজেলাতেই রোগীর সংখ্যা ৯৩১ জন। তাদের মধ্যে ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন চারজন।
মেহেরপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অলোক কুমার জানান, ২০০৩ ও ২০০৪ সালের দিকে মেহেরপুরের আলমপুর গ্রামে প্রথম আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে সোডাপ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা আর্সেনিক রোগী শনাক্ত ও তাদের চিকিৎসা প্রদান করলে অনেক রোগী সুস্থও হয়ে যায়। পরে সংস্থাটি আর্সেনিক নিয়ে আর কোনো কাজ করতে পারেনি। সরকারিভাবেও এর জন্য কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর টিউবওয়েল পরীক্ষা ও শনাক্ত করা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জেলার আর্সেনিক নিয়ে কাজ করা খুবই জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।
গাংনী উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মাহাফুজুর রহমান জানান, গাংনী উপজেলায় ২১ হাজার ৪৪৫টি টিউবওয়েলের পানি পরীক্ষা করা হয়েছে। এরমধ্যে এক হাজার ৬০০টি টিউবওয়েলের পানিতেই অতিমাত্রায় আর্সেনিক পাওয়া গেছে। টিউবওয়েলগুলোকে লাল চিণ্হ দেওয়া হলেও মানুষ সেখানকার পানি পান করছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে মেহেরপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহা. মোসলেহ উদ্দীন বলেন, আর্সেনিকের ভয়াবহতা দেখে মানুষকে আমরা সচেতন করছি। বিভিন্ন স্থানে আর্সেনিকমুক্ত পানির জন্য প্লান্ট স্থাপন করে দিয়েছি। অনেকেই আর্সেনিককে কিছুই মনে না করে লাল চিহ্নিত টিউবওয়েলের পানি পান করছেন। আমাদের এ কাজ চলমান রয়েছে।
মেহেরপুর সিভিল সার্জন জওয়াহেরুল আনাম সিদ্দিকী বলেন, আর্সেনিক আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এখন আর কেউ চিকিৎসা নিতে আসতে চান না। তবে রোগীরা এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত মানুষের তালিকা করে ওষুধ সরবারহ করি। একটি বিদেশি সংস্থা আমাদের সহযোগিতা করে আসছিল। ওই সংস্থাটির আর্সেনিক প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়ার কারণে আমরা কাজ করতে পারছি না।